মোংলার যৌনপল্লীর কর্মীরা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে
- আপডেট টাইম : ০৬:০৩:১৩ পূর্বাহ্ণ, শনিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩
- / ৬৭২ ৫০০০.০ বার পাঠক
বানীশান্তা এক সময় দেশের সবচেয়ে বড় পতিতা পল্লী হিসেবে স্বীকৃত ছিল। ১৯৫৪ সালে যখন মোংলা সমুদ্র বন্দর গড়ে ওঠে তখন থেকেই এই পতিতা পল্লীর যাত্রা। এটি তখন আজকের জায়গাটিতে ছিল না। ছিল মোংলা শহরতলীর কুমারখালী খালের উত্তরে। প্রথমে ২০/২৫ যৌন কর্মী নিয়ে পতিতা পল্লীর যাত্রা শুরু হয়েছিল। তারপর যখন ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে মোংলা বন্দরের শহর বড় হয়, লোকসংখ্যা বাড়ে তখন পতিতা পল্লীটিও পশুর নদীর পশ্চিম পাড়ে স্থান্তরিত হয়। পতিতা পল্লীর পতিতালয়ে বসবাসকারী যৌন কর্মীরা পুরোপুরি পেশাদার, তাদের জীবন জীবিকা সম্পূর্ণভাবেই যৌন কর্মের উপর নির্ভর করে। সমাজের ভিতর তাদের কোনো ধরনের অবস্থান যেমন নেই, তেমনি যৌনকর্মী বাদে তাদের আর কোনো পরিচয় থাকে না। যৌন কর্মীদের জীবনের কষ্টের কথা খুবই কম মানুষই জানে। প্রত্যান্ত অঞ্চলের হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে প্রতারক চক্র কিংবা ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে আবার কখনো বিদেশে যাওয়ার লোভে পড়ে যৌন পল্লীতে আসে। যে বিষয়গুলো থেকে ওরা বঞ্চিত তাহলো, সঠিক চিকিৎসার অভাব, স্যানিটেশনের অভাব, সুপিয় খাবার পানির সমস্যা, সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের প্রতিবন্ধকতা,বৃদ্ধ বয়সে মানবেতর জীবনযাপন, সরকারি বিভিন্ন সহায়তা, ভাতার অভাব, স্থানীয় পর্যায়ে হয়রানি ও নির্যাতন, কর্মসংস্থান ও পূর্ণবাসনের অভাব, নদী ভাঙ্গনের সমস্যা, সামাজিক সন্মান এর অভাব, আর্থিক অসচ্ছলতা।
যৌনকর্মীরা জানায় যে, আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য আমাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ বহন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না হওয়ায় এই বৃদ্ধ বয়সে আমাদের যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই। পূর্ণবাসনের সাথে সাথে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ চায়।
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের দেখা হয় সমাজের কলঙ্ক হিসেবে। তারা এখানে প্রতিনিয়ত অবজ্ঞা, অবহেলার শিকার হন। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন। মুলধারার সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তাদের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শেষ থাকেনা।
যেখানে যৌনকর্মীদের চরিত্রহীন হিসেবে গন্য করা হয়। তারা কেবল নিগৃহীত, নিপীড়িতই হন। সমাজে কেউ তাদের দাম দেননা, সম্মানতো দূরের কথা। পেশার কারণে পরিবারও ওদের গ্রহণ করেনা। প্রতি পদে পদে বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়। ওদের ছেলে মেয়েরাও চিকিৎসা, শিক্ষা, বাসস্থান এবং সরকারি সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
স্বাভাবিকভাবেই আজ পতিতাবৃত্তি কোনো আকাঙ্ক্ষিত জীবন ধারা নয়। অনেকে পেশা ছেড়ে দিতে মরিয়া। সুস্থ জীবনের আশায় একে পেছনে ফেলতে চান। কিন্তু সেইপথে কতটা সফল হন তারা? দারিদ্র, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, অসহায়ত্ব, বলপ্রয়োগ, অপব্যবহারের কারণে যৌনকর্মে যোগ দেন নারীরা। অনেকে প্রলোভনে পড়ে এ পেশায় নিয়োজিত হন। তাদের উন্নত জীবন দেয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু পরিবর্তে পতিতালয়ে বিক্রি করা হয়।
যারা বিক্রি হন, তারা মূলত চুক্তিভিত্তিক সেখানে থাকেন। নির্দিষ্ট মেয়াদের আগে নিজেদের মুক্ত করতে বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেন ওরা। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এ পেশা ছেড়ে দেবেন,না স্বাধীন থাকবেন। মেয়াদ শেষে অনেকে তা ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরতে চান।
তবে নতুনভাবে তাদের জীবন শুরু করা কঠিন। কারণ,শরীরে অতীতের দুর্গন্ধ লেগে থাকে। তারা সমাজে ঠাঁই করে নিতে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত জীবন-জীবিকার জন্য ফের সেখানে ফিরে যান।
সচরাচর এদেশে বিপাকে পড়ে যৌনকর্ম জীবন গ্রহণ করেন নারীরা। বেঁচে থাকার জন্য যা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দের জন্য এপথ কখনই বেছে নেন না কেউ। পতিতালয় হচ্ছে জেলখানা। যেখানে জীবিকার তাগিদে কাজ করেন তারা। কেউ কেউ কম বয়সেও এই কাজে বাধ্য হন। আবার অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদেরই এখানে বিক্রি করা হয়।
বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তি আইনে কমবয়সী বালিকাদের বিক্রি করা নিষিদ্ধ। ৩৬৪-এ, ৩৬৬-এ ও ৩৭৩ ধারায় বলা হয়েছে, কমবয়সী বালিকাদের বিক্রি করা গুরুতর অপরাধের আওতায় পড়বে। এর শাস্তি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। প্রেমের নামে ফুসলিয়ে কিংবা সৎ মায়ের কারসাজিতে শিশুগুলো যৌনপল্লীতে স্থান পেয়েছে এমনটাই দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি।
যৌন কর্মীরা জানান, উন্নয়ন সংস্থা সিএসএস এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে রোথেল ভিত্তিক যৌনকর্মী এবং পরিবহন শ্রমিকদের এইচআইভি/ এইডস্ এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে কাজ করে থাকে।
যেসব লোকজন নারীদের পতিতাবৃত্তির পথ বেছে নিতে বাধ্য করেন অথবা পতিতালয়ে বিক্রি করেন; পরে সেই তারাই তাদের সমাজবিচ্যুত করেন। সুশীল সমাজ থেকে যৌনকর্মীদের উচ্ছেদ করেন ওই কুচক্রী মহলই। যৌনকর্মীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দেখলেই সুশীল লোকদের ভন্ডামিটাও স্পষ্ট হয়।
কিছু মেয়ে সেখানেই জন্ম নেয়। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের দেখভালের জন্য এ পেশায় জড়িয়ে পড়ে। বাকিরা পাচার হয়ে আসা। পল্লীর ‘ম্যাডামরা’ তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন।
অপহৃত মেয়ে শিশুদের অধিকাংশের স্থান হয় যৌন পল্লীতে। পরিণামে এসব ভবঘুরে শিশুদের সাহায্যার্থে হাত না বাড়িয়ে তাদের উপর অত্যাচারের পথ প্রশস্ত করা হয়। ওদের ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয় অসাধু লোকজন।
ঐ এলাকার পশুর নদীর পশ্চিম পাড়ে বানিয়াশান্তা ইউনিয়নবাসীসহ তারাও এখন নদী ভাঙ্গন আতংকে রাত কাটাচ্ছে। নদীতে জোয়ার আসলেই ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে আর ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে আশ্রায় নিতে হচ্ছে নদীর বাধের উপর। এরকম ঘটনা চলছে প্রায়। ভাঙ্গন কবলিত বানিশান্তা ইউনিয়নের আমতলা পুলিশ ফাড়ী থেকে শুরু করে বানিশান্তা বাজারের দক্ষিনপাশ পর্যন্ত চলছে নদী ভাঙ্গন। ২০১৩ সালে পশুর নদীর ভেড়ীবাধ রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্তাবধনে চায়না কোম্পানীর মাধ্যমে বেড়ীবাধ দেয়া হয় কিন্ত এটি ২০১৭ সালের দিকে ভাঙ্গন শুরু হলে পুনরায় এবাধ সংস্কারের কোন উদ্যোগ নেয়নী কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সালের জুনের দিকে বেড়ীবাধটি ভেঙ্গে প্রায় কয়েকটি গ্রাম তলীয়ে যায় আর পানিবন্ধী হয়ে পড়ে প্রায় ৫ সহস্রাধীক লোক।