“গাজীপুর জেলার জাহাঙ্গীর আলম একটি আলাউদ্দিনের চেরাগ”
- আপডেট টাইম : ০৭:২৬:৪০ পূর্বাহ্ণ, শনিবার, ২০ নভেম্বর ২০২১
- / ৩৫৪ ৫০০০.০ বার পাঠক
বিশেষ প্রতিনিধি রিপোর্ট।।
গাজীপুরের বোর্ডবাজারে মূল সড়কের পাশে গতকাল দুপুরে ডাব বিক্রি করছিলেন সোনা মিয়া। তিন-চারজন ডাব খাচ্ছিলেন আর মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ব্যাপারে নানা ধরনের মন্তব্য করছিলেন। একজন বললেন, ‘টাকা, মুখ ও দম্ভ- এ তিনটিই ডুবিয়েছে তাকে।’
মেয়র জাহাঙ্গীরকে নিয়ে এমন আলোচনা গাজীপুরের অলিগলি, চায়ের দোকান সর্বত্র। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তি করায় জাহাঙ্গীরকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। তার প্রাথমিক সদস্যপদও বাতিল করা হয়েছে। একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, মেয়রকে অভিযুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাও করা হতে পারে। সূত্র বলছে, তার মেয়র পদ হারানোও এখন সময়ের ব্যাপার।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গাজীপুরে বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা। কী হচ্ছে, কী হতে পারে- এ-সবই স্থানীয়দের মুখে মুখে ঘুরছে। মেয়র জাহাঙ্গীরের বিষয়ে এখন অনেকে খোলামেলা কথা বলছেন।
মেয়র জাহাঙ্গীরের নানাবাড়ি গাজীপুরে। তবে তার দাদার বাড়ি নোয়াখালী। বাবা মিজানুর রহমান বিয়ের সূত্রে গাজীপুরের কানাইয়া গ্রামে বসবাস শুরু করেছিলেন। কৃষক মিজানুরের অভাবের সংসারে ১৯৭৯ সালে জন্ম জাহাঙ্গীরের। স্থানীয় চান্দনা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজে। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে পরে মামা শফিকুল আলম তাকে নিজের কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলার সময় বেরিয়ে এলো- শফিকুল ছিলেন বিএনপি নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টুর ইসলামপুরের বাগানবাড়ির কেয়ারটেকার। ১৯৯০-৯১ সালের দিকে মিন্টু গাজীপুরে প্রচুর জমিজমা কেনার দায়িত্ব দেন শফিকুলকে। পরে তিনি এর সঙ্গে ভাগ্নে জাহাঙ্গীরকে যুক্ত করেন।
এলাকার একাধিক প্রবীণ ব্যক্তির ভাষ্য, ওই সময় এক কারখানা মালিকের জমি কেনার অনেক পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেন জাহাঙ্গীর। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে রাজনীতিতে জড়িয়ে এবং ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে ভাগ্যের চাকা দ্রুত ঘোরাতে থাকেন। যেন এক জাদুর কাঠির স্পর্শে ফুলেফেঁপে ওঠার গল্প। পরে একাধিক দেহরক্ষী নিয়ে চলতেন। ভিভিআইপিদের আদলে তার গাড়িবহরের পেছনে সব সময় থাকত অ্যাম্বুলেন্স।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগটি স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, ‘ছাত্রজীবন ও রাজনীতির জীবনে কখনও কোনো কারখানা মালিকের কাছ থেকে টাকা নিইনি।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের অর্থ আয়ের একটি বড় খাত হলো গাজীপুর ও ময়মনসিংহ এলাকায় বিভিন্ন গার্মেন্টের ঝুট ও সুতার কারবার। একসময় তিনি নিজে এসব দেখভাল করতেন। এখন বিশ্বস্ত সহযোগীদের দিয়ে করান। এ ছাড়া গাজীপুর এলাকায় বিভিন্ন কারখানার ট্রেড লাইসেন্স আটকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগটি স্বতন্ত্রভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে মেয়র জাহাঙ্গীর আলম দাবি করেন, ‘ছাত্রজীবন ও রাজনীতির জীবনে কখনও কোনো কারখানা মালিকের কাছ থেকে টাকা নিইনি।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের অর্থ আয়ের একটি বড় খাত হলো গাজীপুর ও ময়মনসিংহ এলাকায় বিভিন্ন গার্মেন্টের ঝুট ও সুতার কারবার। একসময় তিনি নিজে এসব দেখভাল করতেন। এখন বিশ্বস্ত সহযোগীদের দিয়ে করান। এ ছাড়া গাজীপুর এলাকায় বিভিন্ন কারখানার ট্রেড লাইসেন্স আটকে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
জাহাঙ্গীরের হয়ে যারা গার্মেন্টের কারবার নিয়ন্ত্রণ করেন তারা হলেন- মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বেনসন মুজিবর, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজি মনির ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম। মেয়রের সান্নিধ্যে থেকে এলাকায় কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি করেন কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর। এ ছাড়া মেয়রের দেহরক্ষী হিসেবে পরিচিত আশরাফুল আলম রানা ওরফে রানা মোল্লা ইটাহাটা এলাকায় প্রাসাদোপম বাড়ি নির্মাণ করেন। কয়েক মাস গাজীপুরে টিআরজেড কারখানায় সশরীরে হাজির হয়ে ঝুট দেওয়ার দাবি করেন মেয়র।
মেয়রের পক্ষে সাতইশ এলাকায় চাঁদাবাজি ও ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন যুবলীগ নেতা মো. টুটুল, বিপ্লব হোসেন ও আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল উদ্দিন। হেলালের নিয়ন্ত্রণে আছে দেওড়া ও মিলগেট এলাকা। এলাকাবাসীর অভিযোগ ছাড়া একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে তাদের চাঁদাবাজির তথ্য তুলে ধরা হয়। ঝুট ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রণ বন্ধ ও উদ্ভূত পরিস্থিতি সঠিকভাবে মোকাবিলা করা না গেলে মেয়রপন্থি ও মেয়রবিরোধী পক্ষের মধ্যে সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেয়রের গোপন আর্থিক বিষয় দেখভাল করেন মহানগর আওয়ামী লীগের সহদপ্তর সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম ও মনিরুল ইসলাম ওরফে সুন্দর মনির। অভিযোগ আছে, কোনো নিয়মনীতি না মেনে নিজের পছন্দের লোকজনকে বাজার ও গরুর হাট ইজারা দেন মেয়র। বোর্ডবাজার ইজারা পান তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত রুবেল খান মন্টু। টঙ্গী পেয়েছেন মনি সরকার। সাইনবোর্ডের বাজার পেয়েছেন আবদুর রশিদ।
তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের কয়েকজনের বক্তব্য নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হয়। তাদের মধ্যে যুবলীগ নেতা মো. টুটুল সমকালকে বলেন, সাতাইশ বাজার কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। আমার বিরুদ্ধে চাঁদা তোলার অভিযোগ কেউ প্রমাণ করতে পারবে না।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোটি কোটি টাকার কাজ, গার্মেন্টে ঝুট ও সুতার কারবার, বাজার ও গরুর হাট ইজারা নিজের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য মেয়রের। এ ছাড়া টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমার নানা কাজ নিজের লোকদের মাধ্যমে করিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতা ও রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমের ওপর তথ্য রাখেন- এমন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আজমত উল্লা খানের সঙ্গে বাহ্যিক সম্পর্ক রেখে চলতেন জাহাঙ্গীর। প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে আজমত উল্লার বাসস্থান টঙ্গী পূর্ব এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকেন মেয়র। এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে দূরত্ব আরও বাড়ে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি দেওয়াকে কেন্দ্র করে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে নতুনভাবে দূরত্ব তৈরি হয় মেয়রের। আহ্বায়ক কমিটিকে জাহাঙ্গীর তার সমর্থক ও অনুসারীদের প্রাধান্য দেন। এমনকি মেয়র হওয়ার পর গাজীপুরের ঠিকাদারি কাজ তার ঘনিষ্ঠ লোকজনই বেশি পেয়েছেন। আজমত ও রাসেলের লোকজন ঠিকাদারি কাজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামও নেওয়া হতো না। জাহাঙ্গীরের নিজস্ব পরিচয় তুলে ধরতেই ওই ফাউন্ডেশনকে ব্যবহার করা হয়।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একাধিক কাউন্সিলরের অভিযোগ- প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন হত্যার ঘটনায় মেয়রের ভূমিকা সন্দেহজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ। ওই ঘটনার পর সিটি করপোরেশন থেকে কোনো শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়নি। মানববন্ধনসহ অন্য কোনো কর্মসূচিও পালন করেননি কেউ।
অভিযোগ আছে, একই প্রকল্প তিনবার দেখিয়ে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা গায়েব করার পরিকল্পনা করেছিল একটি প্রভাবশালী চক্র। এতে বাধা হয়ে দাঁড়ালে দেলোয়ারকে প্রাণ দিতে হয়। ওই হত্যার পর মেয়রের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সুন্দর মনির কিছুদিন গা-ঢাকা দেন।
এলাকাবাসী জানান, কয়েক মাস আগে গাজীপুর মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের স্বামী মো. খোরশেদ ফেসবুকে এসে মেয়রের সঙ্গে তার স্ত্রীকে নিয়ে অনেক কথা বলেন। এর পরদিনই স্ত্রীর মামলায় গ্রেপ্তার হন খোরশেদ। এ ঘটনায় তাদের সংসার ছাড়াছাড়ি হয়।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল্লাহ আল মামুন সমকালকে বলেন, মেয়রের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে অনেকেই মুখ খুলতে সাহস করেন না। বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। অনিয়ম করে শত শত লোকজনকে সিটি করপোরেশনে চাকরি দেন।
গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি আজমত উল্লা খান সমকালকে বলেন, মেয়রের বক্তব্য ধৃষ্টতাপূর্ণ। এটা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী দূরে থাক; বিরোধী দলের নেতাকর্মীরাও ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস করবে না। তার এই বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, আইন পর্যালোচনা করে জাহাঙ্গীরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
অঝোরে কাঁদলেন মেয়র: গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, ভোর থেকেই সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে তার কর্মী-সমর্থকরা আসতে শুরু করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাড়ঘেঁষা গাজীপুর মহানগরের ছয়দানা এলাকার বাড়িতে জড়ো হন হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক ও আত্মীয়স্ব্বজন। মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দলের প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে বহিস্কৃত গাজীপুর সিটি মেয়র জাহাঙ্গীরের নামে স্লোগান দিতে থাকেন তার ভক্ত-অনুরাগী ও সমর্থকরা। এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা হাজির হন চতুর্থ তলা বাড়ির নিচতলায়। গতকাল শনিবার দুপুরের দিকে জাহাঙ্গীর নিচে নেমে আসেন। নেতাকর্মীদের সামনে এসে অঝোরে কাঁদতে থাকেন জাহাঙ্গীর।
উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে মেয়র জাহাঙ্গীর বক্তব্যও দেন। এ সময় তিনি বলেন, আমি নগরবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এখানে দাঁড়িয়েছি। আমি এই নগরবাসীর জন্য রাস্তা করতে আট হাজার বিঘা জায়গা চেয়ে নিয়েছি; ৮০০ কিলোমিটার রাস্তা সমাপ্তির পথে। ৩২ হাজার বাড়িঘর ও দোকান তারা নিজ উদ্যোগে সরিয়ে নিয়েছিলেন। সে জন্য আমি নগরবাসীর কাছে ক্ষমা চাই। এ রাস্তাগুলো আমার ব্যবহারের জন্য নয়। প্রধানমন্ত্রী একটি দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করতে। সে উদ্যোগ বাস্তবায়নে আমি কাজটি শুরু করেছিলাম।
জাহাঙ্গীর বলেন, আমি পদ চাই না। আওয়ামী লীগের সমর্থক হয়ে থাকতে চাই। মানুষ মাত্রই ভুল করে। আমরা কেউ ভুলের ঊর্ধ্বে না। আমারও ভুল হতে পারে। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ে বহিস্কারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা এবং আওয়ামী লীগের একজন সাধারণ সমর্থক হয়ে দলের পাশে থাকার সুযোগ চাই। দলের এ সিদ্ধান্ত আমার জন্য খুবই বেদনাদায়ক। মহানগরে ২ হাজার ৮০০ কারখানা রয়েছে। ছাত্রজীবন ও রাজনৈতিক জীবনে কখনও কোনো কারখানার মালিকের কাছ থেকে টাকা নিইনি। কিছু মিথ্যাবাদী প্রধানমন্ত্রীর কাছে বলেছে, আমার দল এবং সিটি করপোরেশন চালানোর জন্য আমরা নাকি কারখানা থেকে টাকা তুলি। আমরা নাকি মানুষের জমি নিয়েছি।