ঢাকা ০৩:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪
সংবাদ শিরোনাম ::

বাংলার শক্তির ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনের অন্তরালে

সময়ের কন্ঠ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : ০১:৫১:৪৫ অপরাহ্ণ, শনিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২১
  • / ৩০১ ৫০০০.০ বার পাঠক

সম্পাদক সাথী।।

গত ২৯ নবেম্বর, ২০২০ রবিবার হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক বলেন, আইনী, নৈতিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সামর্থ্য হলে সব ভাস্কর্যই এই জনপদ থেকে অপসারণ করার উদ্যোগ নেয়া হবে। পুরানা পল্টনে খেলাফত মজলিসের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে গত ১৩ নবেম্বর করোনাকালীন যাবতীয় বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে ঢাকার গেণ্ডারিয়ার ধুপখোলার মাঠে সমাবেশ করে মুহাম্মদ মামুনুল হক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ হলে তা বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার হুমকি দিয়ে বক্তব্য দেন। তারপর থেকেই ভাস্কর্য ইস্যুতে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী শাসনতন্ত্র ও চরমোনাই পীরসহ ধর্মান্ধ দলগুলো মাঠে নামে। সবশেষে হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরীর কড়া ভাস্কর্যবিরোধী অবস্থান ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে উস্কে দেয়। তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর এক ওয়াজ মাহফিলে বলেন, কেউ যদি আমার আব্বার ভাস্কর্য স্থাপন করে, সর্বপ্রথম আমি আমার আব্বার ভাস্কর্যকে ছিড়ে, টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দেব।

জামায়াতী, হেফাজতী তথা ধর্মান্ধ দলগুলো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধে সারাদেশে বেশ কিছুদিন লাগাতার বিক্ষোভ সমাবেশ করে। প্রথম দিকে সরকার ও সরকারী দল নীরব থাকলেও পরে সরকার ও আওয়ামী লীগ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। প্রতিবাদে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনসহ স্বাধীনতার পক্ষের সকল রাজনৈতিক দল। তীব্র বিক্ষুব্ধ জনরোষে ধর্মান্ধ হেফাজতী-জামায়াতীরা চাপে পড়ে এবং ব্যাকফুটে চলে যায়। অবশেষে নমনীয় হয়ে সরকারের কাছে আপোস প্রস্তাব পাঠায়। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের সুনজরে থাকা হেফাজত ইসলাম হঠাৎ করে কেন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী ইস্যু বানিয়ে আন্দোলনের মাঠে নামে? হেফাজতের অতি প্রবীণ নেতা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর জামায়াতে ইসলামী জুনায়েদ বাবুনগরীর মাধ্যমে হেফাজতকে গিলে ফেলছে। হেফাজতের যে ১৩ দফার সব কটিই জামায়াতে ইসলামীরই পুরনো দাবি।

২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় যে মহাতাণ্ডব হয়েছিল, সেখানেও জামায়াত-বিএনপি আত্মরক্ষার ঢাল হিসেবে হেফাজতকে ব্যবহার করে। ঐ সময়ের মহাতাণ্ডবের পর এই জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনটির বিরুব্ধে সরকার কিছুটা শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছিল। কারণ, শাপলা চত্বরের মহাসন্ত্রাসের কারণ নিছক হেফাজতের ১৩ দফা বাস্তবায়নের জন্য ছিল না। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল পরদিন সচিবালয় দখল করে সরকার উৎখাত করা। ৫ ও ৬ মে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে জামায়াত-বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদে হেফাজত যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, এরপর কঠোর অবস্থানে যাওয়া ছাড়া সরকারের অন্য কোন পথ খোলা ছিল না। সরকারের গোয়েন্দাদের কাছে আগেই এই তাণ্ডবের খবর ছিল। বাবুনগরীকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বলে দিয়েছিলেন কিভাবে জামায়াত-বিএনপিকে নিয়ে তারা সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিলেন। কথা ছিল বাবুনগরীকে জামায়াত-বিএনপি জোট প্রধানমন্ত্রী বানাবে। শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার এবং তাদের বিরুব্ধে কয়েক ডজন মামলা দায়েরের পর সারাদেশে হেফাজতীরা গর্তে ঢুকে গিয়েছিল। ঐ সময় রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করতেন, প্রশাসন এবং আওয়ামী শীর্ষ নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছিলেন– সরকার যখন জামায়াত-বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছে, তখন হেফাজতকে ওদের খপ্পর থেকে বের করে আনতে হবে। সেক্যুলার ও সংখ্যালঘুদের ভোট তো আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোট আছেই, উপরন্তু হেফাজতের ভোট পেলে অতিসহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে কিংবা ক্ষমতায় থাকা যাবে।

প্রধানমন্ত্রী যদি নিজে লিখে দেন যেন কাল থেকে তিনি বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়াহ ও ব্লাসফেমি আইন চালু করবেন, সব কাজ হবে ওদের কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী, তারপরও পাকিস্তানপ্রেমী মৌলবাদীরা কখনও আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। কারণ একটাই, আওয়ামী লীগ পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য দায়ী। গণজাগরণের ব্লগার রাজীবকে হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী কঠোর ভাষায় বলেছিলেন, হেফাজত-জামায়াতকে আর ছাড় দেয়া যাবে না। এর কয়েক মাস পরই দেখা গেল হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য। বোঝা গিয়েছিল সরকার হেফাজতকে কিছু সুবিধা দিয়ে কিছু সময়ের জন্য পোষ মানিয়েছিল। আর হেফাজতও সাময়িকভাবে তার বিষাক্ত ফণা নামিয়েছিল কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য এবং পাঠ্যপুস্তক থেকে অমুসলিম ও প্রগতিশীল লেখক কবি-সাহিত্যিকদের রচনা বাদ দেয়ার জন্য। কাজ হাসিলের পর ২০১৭ সালে সুপ্রীমকোর্টের সামনে থেকে লেডি জাস্টিসিয়ার ভাস্কর্য সরাবার জন্য আবার যেই না তর্জনগর্জন শুরু করেছে, সরকার সঙ্গে সঙ্গে সেটি সবার দৃষ্টির আড়ালে সরিয়ে নেয়।

ভাস্কর্যের বিরোধিতা হেফাজতের নতুন বা মুখ্য বিষয় নয়। তখন হেফাজত নেতা বাবুনগরী তাদের সমাবেশে গ্রীক দেবীর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়ে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, সুপ্রীমকোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্যটি অপসারণ না হলে শাপলা চত্বরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ওই সময় ঢাকার বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রতিবাদ সমাবেশে সংগঠনের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী তখন বলেছিলেন, আমরা ভাস্কর্য এবং কোন সংস্কৃতির বিরোধী নই। বাংলাদেশের ঐতিহ্য বা ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে মিল রেখে ভাস্কর্যটি করা হলে কোন আপত্তি ছিল না । কিন্তু এটি গ্রীক দেবীকে হায়ার করে এনে করা হয়েছে। সেই জন্যই আমাদের আপত্তি।

২০১৭ সালে বাবুনগরী যদি বলে থাকেন, আমরা ভাস্কর্য বা কোন সংস্কৃতির বিরোধী নই, তবে এখন কেন তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণ এবং বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপের হুমকি দিচ্ছে? ওয়াজ মাহফিল ও জলসায় জামায়াত-হেফাজত-খেলাফত নেতাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হবে, বাংলাদেশটা যেন মোল্লা ওমরের আফগানিস্তান কিংবা জিয়াউল হকের পাকিস্তানে আমরা বাস করি। অথবা আমরা আবুবকর বোগদাদীর আইএসের সিরিয়া-ইরাক সীমান্তে কোন অঞ্চলে বাস করি, যেখানে ইচ্ছামতো ইসলামের দোহাই দিয়ে মূর্তি বা ভাস্কর্য ভাঙ্গা যায়। মওদুদীবাদী, ওহাবিবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী জামায়াত-হেফাজত গং ভাস্কর্য বিষয়ে জনগণের কাছে মিথ্যাচার করেই যাচ্ছে।

অথচ পাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ সকল মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য আছে, যা নগরের সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি ইতিহাসের মহানায়কদের প্রতি সম্মান দেখানোর স্মারক। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার প্রাণকেন্দ্রে হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রের ভাস্কর্য রয়েছে, মালয়েশিয়ার রাজধানীতে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীরদের স্মরণে ন্যাশনাল মনুমেণ্ট, ইরানজুড়েই রয়েছে ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির ভাস্কর্য, রয়েছে কবি- ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম ও পারস্যের নেপোলিয়ন বলে খ্যাত নাদির শাহের ভাস্কর্য। তুরস্কজুড়েই আছে আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের মূর্তি। সৌদি আরবের বাণিজ্যিক রাজধানী জেদ্দা, কাতারের রাজধানী দোহা এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে, দুবাইয়ের ইবনে বতুতা মার্কেটে স্থাপিত মূর্তিগুলোকে পৌত্তলিকতা বা মূর্তি আখ্যায়িত করে অপসারণের ধৃষ্টতা দেখাতে কখনও সে সকল দেশের কট্টরপন্থীরা সাহস করেনি।

’৭১ এ ইসলামের নামে গণত্যাকারী ও নারী ধর্ষণকারীদের উত্তরসূরি জামায়াত-হেফাজত-খেলাফত গং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে ঢাকার ধুপখোলার মাঠে বিশাল সমাবেশে এগুলো ভেঙ্গে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপের হুমকি দেয়। সরকারের দুধ কলা দিয়ে পোষা হেফাজতের বিষাক্ত ফণা ভাস্কর্য ভাঙ্গার নামে সরকারের টিকিটি ধরেই টান দেয়নি, তারা স্বাধীনতার চেতনায়ও আঘাত করেছে। সরকার যখন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মুজিববর্ষ উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাস্কর্য স্থাপনে ব্যস্ত, তখন হেফাজত গং ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার হুমকি সরাসরি স্বাধীনতার চেতনাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। প্রথম দিকে সরকার নীরব থাকলেও দুদিন বাদে সরকারের তরুণ প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করার পর থেকেই সরকারী দল ও স্বাধীনতার পক্ষের সকল দল ও সামাজিক সংগঠনগুলো সন্ত্রাসী রাজনীতি বন্ধের দাবিতে সারাদেশে লাগাতার সমাবেশ, মানববন্ধন করে।

অবস্থা বেগতিক দেখে হেফাজত-খেলাফত নেতারা সুর পাল্টেছে। এখন তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতার কথা বলেছে। তারা এখন বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানতেও রাজি আছে- শুধু মূর্তি বানানোর বিরোধী। বঙ্গবন্ধুর নামে আল্লাহ্র মিনার নির্মাণের কথাও তারা বলেছে, যেমনটি বিমানবন্দরের সামনে করা হয়েছে বাউল ভাস্কর্য সরিয়ে। সরকারকে মনে রাখতে হবে। এখানে ভাস্কর্য বা মূর্তি কোন বিষয় নয়। আসল বিষয় হচ্ছে পর্দার অন্তরালের নেপথ্য শক্তির ইশারায় ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনে নামে দেশে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের মাধ্যমে আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার দুরভিসন্ধি। ওয়াজের নামে গৃহযুদ্ধের হুমকি প্রদানকারী হেফাজত-খেলাফতীদের যাবতীয় মদদদাতা বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। লন্ডনে তারেক রহমান কখন কোথায় আইএসআইএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে হেফাজত-খেলাফতকে কিভাবে মাঠে নামিয়েছে তা গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে সে খবর গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে শেখ হাসিনা সরকারকে যে কোন পন্থায় ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে বাংলাদেশে মোল্লা উমরের তালেবান কিংবা জিয়াউল হকের পাকিস্তানের মতো ইসলামী হুকুমত চালু করা।

তাই এই মুহূর্তে দেশবাসীর দাবি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর ’৭২-এর সংবিধান অনুযায়ী সব রকম ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্যই বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে হত্যা, সন্ত্রাস ও হিংসা-বিদ্বেষের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। পাশাপাশি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের কোন মন্ত্রী সব জেনেও যদি স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির রাজনৈতিক-আদর্শিক উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে কোন বৈঠক বা সমঝোতার চেষ্টা করেন, তবে সেটি শুধু সরকারের জন্যই আত্মঘাতী হবে না, ৩০ লাখ শহীদ এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মদানের প্রতিও হবে চরম অসম্মান।

আরো খবর.......

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

বাংলার শক্তির ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনের অন্তরালে

আপডেট টাইম : ০১:৫১:৪৫ অপরাহ্ণ, শনিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০২১

সম্পাদক সাথী।।

গত ২৯ নবেম্বর, ২০২০ রবিবার হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক বলেন, আইনী, নৈতিক, রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সামর্থ্য হলে সব ভাস্কর্যই এই জনপদ থেকে অপসারণ করার উদ্যোগ নেয়া হবে। পুরানা পল্টনে খেলাফত মজলিসের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে গত ১৩ নবেম্বর করোনাকালীন যাবতীয় বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে ঢাকার গেণ্ডারিয়ার ধুপখোলার মাঠে সমাবেশ করে মুহাম্মদ মামুনুল হক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ হলে তা বুড়িগঙ্গায় ছুড়ে ফেলার হুমকি দিয়ে বক্তব্য দেন। তারপর থেকেই ভাস্কর্য ইস্যুতে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলন, ইসলামী শাসনতন্ত্র ও চরমোনাই পীরসহ ধর্মান্ধ দলগুলো মাঠে নামে। সবশেষে হেফাজতে ইসলামের আমির জুনাইদ বাবুনগরীর কড়া ভাস্কর্যবিরোধী অবস্থান ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে উস্কে দেয়। তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর এক ওয়াজ মাহফিলে বলেন, কেউ যদি আমার আব্বার ভাস্কর্য স্থাপন করে, সর্বপ্রথম আমি আমার আব্বার ভাস্কর্যকে ছিড়ে, টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দেব।

জামায়াতী, হেফাজতী তথা ধর্মান্ধ দলগুলো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধে সারাদেশে বেশ কিছুদিন লাগাতার বিক্ষোভ সমাবেশ করে। প্রথম দিকে সরকার ও সরকারী দল নীরব থাকলেও পরে সরকার ও আওয়ামী লীগ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। প্রতিবাদে মাঠে নামে আওয়ামী লীগ সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনসহ স্বাধীনতার পক্ষের সকল রাজনৈতিক দল। তীব্র বিক্ষুব্ধ জনরোষে ধর্মান্ধ হেফাজতী-জামায়াতীরা চাপে পড়ে এবং ব্যাকফুটে চলে যায়। অবশেষে নমনীয় হয়ে সরকারের কাছে আপোস প্রস্তাব পাঠায়। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের সুনজরে থাকা হেফাজত ইসলাম হঠাৎ করে কেন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী ইস্যু বানিয়ে আন্দোলনের মাঠে নামে? হেফাজতের অতি প্রবীণ নেতা আহমদ শফীর মৃত্যুর পর জামায়াতে ইসলামী জুনায়েদ বাবুনগরীর মাধ্যমে হেফাজতকে গিলে ফেলছে। হেফাজতের যে ১৩ দফার সব কটিই জামায়াতে ইসলামীরই পুরনো দাবি।

২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় যে মহাতাণ্ডব হয়েছিল, সেখানেও জামায়াত-বিএনপি আত্মরক্ষার ঢাল হিসেবে হেফাজতকে ব্যবহার করে। ঐ সময়ের মহাতাণ্ডবের পর এই জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনটির বিরুব্ধে সরকার কিছুটা শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেছিল। কারণ, শাপলা চত্বরের মহাসন্ত্রাসের কারণ নিছক হেফাজতের ১৩ দফা বাস্তবায়নের জন্য ছিল না। এর প্রধান লক্ষ্য ছিল পরদিন সচিবালয় দখল করে সরকার উৎখাত করা। ৫ ও ৬ মে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে জামায়াত-বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদে হেফাজত যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, এরপর কঠোর অবস্থানে যাওয়া ছাড়া সরকারের অন্য কোন পথ খোলা ছিল না। সরকারের গোয়েন্দাদের কাছে আগেই এই তাণ্ডবের খবর ছিল। বাবুনগরীকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বলে দিয়েছিলেন কিভাবে জামায়াত-বিএনপিকে নিয়ে তারা সরকার উৎখাতের পরিকল্পনা করেছিলেন। কথা ছিল বাবুনগরীকে জামায়াত-বিএনপি জোট প্রধানমন্ত্রী বানাবে। শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার এবং তাদের বিরুব্ধে কয়েক ডজন মামলা দায়েরের পর সারাদেশে হেফাজতীরা গর্তে ঢুকে গিয়েছিল। ঐ সময় রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করতেন, প্রশাসন এবং আওয়ামী শীর্ষ নেতারা প্রধানমন্ত্রীকে বুঝিয়েছিলেন– সরকার যখন জামায়াত-বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছে, তখন হেফাজতকে ওদের খপ্পর থেকে বের করে আনতে হবে। সেক্যুলার ও সংখ্যালঘুদের ভোট তো আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোট আছেই, উপরন্তু হেফাজতের ভোট পেলে অতিসহজেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যাবে কিংবা ক্ষমতায় থাকা যাবে।

প্রধানমন্ত্রী যদি নিজে লিখে দেন যেন কাল থেকে তিনি বাংলাদেশে ইসলামী শরিয়াহ ও ব্লাসফেমি আইন চালু করবেন, সব কাজ হবে ওদের কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী, তারপরও পাকিস্তানপ্রেমী মৌলবাদীরা কখনও আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না। কারণ একটাই, আওয়ামী লীগ পাকিস্তান ভাঙ্গার জন্য দায়ী। গণজাগরণের ব্লগার রাজীবকে হত্যার পর প্রধানমন্ত্রী কঠোর ভাষায় বলেছিলেন, হেফাজত-জামায়াতকে আর ছাড় দেয়া যাবে না। এর কয়েক মাস পরই দেখা গেল হেফাজতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য। বোঝা গিয়েছিল সরকার হেফাজতকে কিছু সুবিধা দিয়ে কিছু সময়ের জন্য পোষ মানিয়েছিল। আর হেফাজতও সাময়িকভাবে তার বিষাক্ত ফণা নামিয়েছিল কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য এবং পাঠ্যপুস্তক থেকে অমুসলিম ও প্রগতিশীল লেখক কবি-সাহিত্যিকদের রচনা বাদ দেয়ার জন্য। কাজ হাসিলের পর ২০১৭ সালে সুপ্রীমকোর্টের সামনে থেকে লেডি জাস্টিসিয়ার ভাস্কর্য সরাবার জন্য আবার যেই না তর্জনগর্জন শুরু করেছে, সরকার সঙ্গে সঙ্গে সেটি সবার দৃষ্টির আড়ালে সরিয়ে নেয়।

ভাস্কর্যের বিরোধিতা হেফাজতের নতুন বা মুখ্য বিষয় নয়। তখন হেফাজত নেতা বাবুনগরী তাদের সমাবেশে গ্রীক দেবীর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি জানিয়ে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, সুপ্রীমকোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্যটি অপসারণ না হলে শাপলা চত্বরের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ওই সময় ঢাকার বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রতিবাদ সমাবেশে সংগঠনের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী তখন বলেছিলেন, আমরা ভাস্কর্য এবং কোন সংস্কৃতির বিরোধী নই। বাংলাদেশের ঐতিহ্য বা ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে মিল রেখে ভাস্কর্যটি করা হলে কোন আপত্তি ছিল না । কিন্তু এটি গ্রীক দেবীকে হায়ার করে এনে করা হয়েছে। সেই জন্যই আমাদের আপত্তি।

২০১৭ সালে বাবুনগরী যদি বলে থাকেন, আমরা ভাস্কর্য বা কোন সংস্কৃতির বিরোধী নই, তবে এখন কেন তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণ এবং বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপের হুমকি দিচ্ছে? ওয়াজ মাহফিল ও জলসায় জামায়াত-হেফাজত-খেলাফত নেতাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হবে, বাংলাদেশটা যেন মোল্লা ওমরের আফগানিস্তান কিংবা জিয়াউল হকের পাকিস্তানে আমরা বাস করি। অথবা আমরা আবুবকর বোগদাদীর আইএসের সিরিয়া-ইরাক সীমান্তে কোন অঞ্চলে বাস করি, যেখানে ইচ্ছামতো ইসলামের দোহাই দিয়ে মূর্তি বা ভাস্কর্য ভাঙ্গা যায়। মওদুদীবাদী, ওহাবিবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী জামায়াত-হেফাজত গং ভাস্কর্য বিষয়ে জনগণের কাছে মিথ্যাচার করেই যাচ্ছে।

অথচ পাকিস্তান ও সৌদি আরবসহ সকল মুসলিম দেশেই ভাস্কর্য আছে, যা নগরের সৌন্দর্য বর্ধনের পাশাপাশি ইতিহাসের মহানায়কদের প্রতি সম্মান দেখানোর স্মারক। বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার প্রাণকেন্দ্রে হিন্দু পৌরাণিক চরিত্রের ভাস্কর্য রয়েছে, মালয়েশিয়ার রাজধানীতে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীরদের স্মরণে ন্যাশনাল মনুমেণ্ট, ইরানজুড়েই রয়েছে ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির ভাস্কর্য, রয়েছে কবি- ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম ও পারস্যের নেপোলিয়ন বলে খ্যাত নাদির শাহের ভাস্কর্য। তুরস্কজুড়েই আছে আধুনিক তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের মূর্তি। সৌদি আরবের বাণিজ্যিক রাজধানী জেদ্দা, কাতারের রাজধানী দোহা এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে, দুবাইয়ের ইবনে বতুতা মার্কেটে স্থাপিত মূর্তিগুলোকে পৌত্তলিকতা বা মূর্তি আখ্যায়িত করে অপসারণের ধৃষ্টতা দেখাতে কখনও সে সকল দেশের কট্টরপন্থীরা সাহস করেনি।

’৭১ এ ইসলামের নামে গণত্যাকারী ও নারী ধর্ষণকারীদের উত্তরসূরি জামায়াত-হেফাজত-খেলাফত গং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে ঢাকার ধুপখোলার মাঠে বিশাল সমাবেশে এগুলো ভেঙ্গে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপের হুমকি দেয়। সরকারের দুধ কলা দিয়ে পোষা হেফাজতের বিষাক্ত ফণা ভাস্কর্য ভাঙ্গার নামে সরকারের টিকিটি ধরেই টান দেয়নি, তারা স্বাধীনতার চেতনায়ও আঘাত করেছে। সরকার যখন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মুজিববর্ষ উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাস্কর্য স্থাপনে ব্যস্ত, তখন হেফাজত গং ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলার হুমকি সরাসরি স্বাধীনতার চেতনাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। প্রথম দিকে সরকার নীরব থাকলেও দুদিন বাদে সরকারের তরুণ প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ফজলে নূর তাপস এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করার পর থেকেই সরকারী দল ও স্বাধীনতার পক্ষের সকল দল ও সামাজিক সংগঠনগুলো সন্ত্রাসী রাজনীতি বন্ধের দাবিতে সারাদেশে লাগাতার সমাবেশ, মানববন্ধন করে।

অবস্থা বেগতিক দেখে হেফাজত-খেলাফত নেতারা সুর পাল্টেছে। এখন তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সমঝোতার কথা বলেছে। তারা এখন বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা মানতেও রাজি আছে- শুধু মূর্তি বানানোর বিরোধী। বঙ্গবন্ধুর নামে আল্লাহ্র মিনার নির্মাণের কথাও তারা বলেছে, যেমনটি বিমানবন্দরের সামনে করা হয়েছে বাউল ভাস্কর্য সরিয়ে। সরকারকে মনে রাখতে হবে। এখানে ভাস্কর্য বা মূর্তি কোন বিষয় নয়। আসল বিষয় হচ্ছে পর্দার অন্তরালের নেপথ্য শক্তির ইশারায় ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনে নামে দেশে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের মাধ্যমে আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার দুরভিসন্ধি। ওয়াজের নামে গৃহযুদ্ধের হুমকি প্রদানকারী হেফাজত-খেলাফতীদের যাবতীয় মদদদাতা বিএনপি-জামায়াত এবং তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। লন্ডনে তারেক রহমান কখন কোথায় আইএসআইএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে হেফাজত-খেলাফতকে কিভাবে মাঠে নামিয়েছে তা গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে সে খবর গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে শেখ হাসিনা সরকারকে যে কোন পন্থায় ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে বাংলাদেশে মোল্লা উমরের তালেবান কিংবা জিয়াউল হকের পাকিস্তানের মতো ইসলামী হুকুমত চালু করা।

তাই এই মুহূর্তে দেশবাসীর দাবি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর ’৭২-এর সংবিধান অনুযায়ী সব রকম ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার জন্যই বঙ্গবন্ধু সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে হত্যা, সন্ত্রাস ও হিংসা-বিদ্বেষের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। পাশাপাশি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের কোন মন্ত্রী সব জেনেও যদি স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির রাজনৈতিক-আদর্শিক উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে কোন বৈঠক বা সমঝোতার চেষ্টা করেন, তবে সেটি শুধু সরকারের জন্যই আত্মঘাতী হবে না, ৩০ লাখ শহীদ এবং বঙ্গবন্ধুর আত্মদানের প্রতিও হবে চরম অসম্মান।