চট্টগ্রাম প্রতিনিধি।।
মৌসুমে দেশি পেঁয়াজ আসতে শুরু করেছে বাজারে, তার আগে অন্যান্য দেশের পেঁয়াজ তো ছিলই। এরই মধ্যে চট্টগ্রামের চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের বড় গুদামগুলো এখন ভারতীয় পেঁয়াজে সয়লাব। বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ মজুদ থাকায় আমদানিকারকরা লোকসানের ভয়ে বাজারে পেঁয়াজ ছেড়ে দেওয়ায় দাম কমতে শুরু করেছে। একই কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হাজার হাজার টন পেঁয়াজ খালাস নিচ্ছেন না আমদানিকারকরা। এতে বিপাকে পড়েছে কৃষক, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা। অপরদিকে ভারতীয় পেঁয়াজের চেয়ে দেশি পেঁয়াজ বেশি বিক্রি হচ্ছে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা জানান, চাহিদার তুলনায় দেশের বাজারে অতিরিক্ত পেঁয়াজ আসায় আমরা আগেও একবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ভারত পেঁয়াজ দিতে চাইলেও বাংলাদেশ সরকারের উচিত ছিল না তা গ্রহণ করা। ভারতীয় পেঁয়াজের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষক, আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা।
গতকাল বুধবার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৩২ টাকা, ভারতীয় ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, মিসর ২৭ থেকে ২৮ টাকা, হল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড ২৫ থেকে ৩০ টাকা এবং তুরস্ক ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এদিকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্র থেকে জানা গেছে, গত ছয় মাসে মিয়ানমার, পাকিস্তান, চীন, মিসর, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আলজেরিয়া, ইরান ও রাশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে ২ লাখ ৯ হাজার ৩৪ টন পেঁয়াজ আমদানির জন্য আইপি নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তার বিপরীতে এ পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ বন্দর থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাজারে পেঁয়াজের দাম পতন হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হাজার হাজার টন পেঁয়াজ খালাস নিচ্ছেন না আমদানিকারকরা। আমদানির পর খালাস নেওয়ার নির্ধারিত ৪৫ দিন পার হলে এসব পেঁয়াজ নিলামে তোলা হবে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরে পড়ে থাকা এই পেঁয়াজের পরিমাণ প্রায় ২৪ হাজার টন।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এসব পেঁয়াজ আমদানি পর্যায়ে দাম পড়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজি। কিন্তু বাজারে এখন পেঁয়াজের দাম পাইকারিতে ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি। বড় অংকের লোকসান এড়াতে আমদানিকারকরা এসব পেঁয়াজ খালাস নিচ্ছেন না।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে পার্থক্য মাত্র ২ লাখ টনের। বছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ২৩ লাখ টনের বেশি। আর চাহিদা রয়েছে ২৪ থেকে ২৫ লাখ টন। তারপরও শুধু নষ্ট হওয়ার কারণে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ টন পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কারণ দেশে উৎপাদিত ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য যে আধুনিক তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকা দরকার, তা সরকারি-বেসরকারি কোনো পর্যায়ে নেই। অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও মজুদে ঘাটতির কারণে গত ১৪ সেপ্টেম্বর ভারত অন্যান্য দেশে পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে বাংলাদেশের বাজারে লাগামহীন পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে।
পরে সরকার পেঁয়াজের ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাস করার পর ব্যবসায়ীরা অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু করে।
খাতুনগঞ্জের হামিদুল্লাহ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস জানান, দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের পেঁয়াজ আসা শুরু করেছে। প্রায় ২০০ টনের মতো পেঁয়াজ খাতুনগঞ্জের বাজারে এসেছে। বর্তমান বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ আছে। বাজারে পেঁয়াজে বড় দর পতন হওয়ায় আমদানিকারকরা বন্দর থেকে পেঁয়াজের চালান খালাস করছেন না। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন প্রায় শত কোটি টাকার পেঁয়াজ খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে।
আলাউদ্দীন আলো নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে আসায় পেঁয়াজের দাম কমেছে। তবে ভারতের পেঁয়াজের চেয়ে দেশি পেঁয়াজ বর্তমানে বেশি বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় পেঁয়াজের কারণে কৃষকদের মধ্যে যারা পেঁয়াজ উৎপাদন করেছেন তারাই এখন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বুলবুল বলেন, গত ছয় মাসে মিয়ানমার, পাকিস্তান, চীন, মিসর, তুরস্ক, নেদারল্যান্ডস, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আলজেরিয়া, ইরান ও রাশিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে ২ লাখ ৯ হাজার ৩৪ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির জন্য আরপি নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তার বিপরীতে এই পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজার টন পেঁয়াজ বন্দর থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা কর্মকর্তা মো. সেলিম বলেন, ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর আমরা কৃষকদের পেঁয়াজ উৎপাদনে উৎসাহিত করেছি। বর্তমানে আমাদের দেশীয় উৎপাদন চাহিদার ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। এখন কৃষকদের ফসলি পেঁয়াজ বাজারে আসছে। বাজারে অন্য দেশের পেঁয়াজও আছে। এর মধ্যে যদি সরকার ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে আসে কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। পরবর্তী সময়ে হয়তো ভারত আবার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে তখন কৃষকরা আর পেঁয়াজ চাষে আগ্রহী হতে চাইবেন না।