বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার বেচাকেনা ডাটাবেজ হচ্ছে মাদক গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণে মাদকাসক্ত শনাক্তে নো-টেস্ট প্রযুক্তি সংযোজন, নিরাময় কেন্দ্রে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালুসহ ১৮ উদ্যোগ
- আপডেট টাইম : ০৪:২২:১৬ পূর্বাহ্ণ, রবিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
- / ২৩২ ৫০০০.০ বার পাঠক
সময়ের কন্ঠ রিপোর্টার।।
মাদক উদ্ধারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এর বেচাকেনা। গত এক যুগে ১৪ হাজার ৩১৩ কোটি টাকার নয়টি বহুল প্রচলিত মাদক উদ্ধার করে সরকারের সংশ্লিষ্টরা। এর বাইরেও নতুন মাদক উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। মাদক উদ্ধারের এ চিত্র খুবই আশঙ্কাজনক-এমন মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, এটি কোনোভাবেই মাদকের পেছনে মোট লেনদেনের ২০-২৫ শতাংশের বেশি নয়। এ অবস্থায় প্রজন্ম রক্ষায় মাদক নিয়ন্ত্রণে ১৮টি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-মাদক গডফাদারদের ডাটাবেজ তৈরি, মাদকাসক্ত শনাক্তে নো-টেস্ট প্রযুক্তি সংযোজন, প্রযুক্তির অপব্যবহার করে মাদক বেচাকেনা বন্ধ, নিরাময় কেন্দ্রে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালু, প্রশিক্ষিত জনবল তৈরিতে ‘ড্রাগ মিউজিয়াম’ স্থাপন এবং মাদক বৃদ্ধি-হ্রাসের ইনডিকেটর তৈরি। এছাড়া আরও কিছু কার্যকর চিন্তা করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এগুলো বাস্তবায়নে একাধিক কমিটি হয়েছে। দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে পৃথক কর্মকর্তাদের। কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়নে দফায় দফায় বৈঠকও করছেন তারা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, মাদক মাফিয়ারা বেচাকেনায় নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। সেবনকারী তৈরি ও বিক্রির চেইন তৈরিতেও কাজ করছে তারা। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে মাদক উদ্ধার সংশ্লিষ্টদের চোখ এড়ানো। ফলে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে তারা। এজন্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির পাশাপাশি এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানানোসহ পরিণত বয়সের মানুষদেরও জীবনঘাতী নেশা থেকে বিরত রাখার কথা বলা হয়েছে সেই সব উদ্যোগে। জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আব্দুস সবুর মণ্ডল শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, এই পরিকল্পনাগুলো করা হয়েছে অতীত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎকে সুন্দর করার জন্য। এখনো ‘ব্রেইন স্ট্রর্মিং’ চলছে। আমরা এর মাধ্যমে কর্মপরিধিকে ঢেলে সাজাব। তৈরি হবে প্রশিক্ষিত জনবল। নিড (প্রয়োজন) অ্যান্ড টার্গেট (লক্ষ্য) বেজড (নির্ভর) কাজ করব। আমাদের নিড হলো মাদকাসক্তিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া। এই ভিশনকে ফোকাসড করে আমরা যা করণীয় সবই করব। ড্রাগ মিউজিয়ামের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের কর্মকর্তাদের ইনভেস্টিগেশনের (তদন্ত) স্বার্থে মাদক সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের জন্য এটি করা হবে। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত নয়। এই মিউজিয়াম দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল তৈরির একটি উদ্যোগ। কারণ আমাদের অনেকেই কিছু ড্রাগের (মাদক) রং কি, আকারে কেমন, দেখতে কেমন হয় তা জানেন না। এ মিউজিয়ামের মাধ্যমে তারা সেটি জানবেন। এটা লার্নিং প্রসেসের একটা অংশ হবে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সচিব তরুণ কান্তি শিকদার যুগান্তরকে বলেন, শিগগিরই আমরা মাদববিরোধী বড় অভিযানে যাব। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে যথাযথ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে একাধিকবার সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। সবশেষ সভা হয়েছে গত বুধবার। তিনি বলেন, অনেক আগেই আমরা মাদকবিরোধী অভিযান-সংক্রান্ত অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করেছি। করোনা পরিস্থিতির কারণে এতদিন ওই প্লান বাস্তবায়ন করা হয়নি। এখন সেটা বাস্তবায়ন করতে চাই।
ডিএনসি সূত্র জানায়, মাদক নিয়ন্ত্রণে অন্যতম উদ্যোগ হলো বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের সংখ্যা নির্ণয়। কারণ দেশে এখনো মাদকাসক্তদের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা হয়নি। ‘নোডাল এজেন্সি’ হিসাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্তৃক এই সংখ্যা নির্ণয় করা হবে। ৫ আগস্ট উদ্ভাবনী পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতিবিষয়ক এক সভায় বলা হয়, মাদক ভোক্তাদের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলমান।
প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধের মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এজন্য মাদকাসক্ত শনাক্তকরণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে নো-টেস্ট প্রযুক্তি সংযোজন করা হবে। তৈরি হবে আকারে হাতঘড়ির মতো লেটেস্ট ডিভাইস। বাস্তবায়নে অগ্রগতি ও সিদ্ধান্তের বিষয়ে অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে ১৯টি জেলার ২১টি স্থানে ডোপ টেস্ট সেন্টার স্থাপনের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। চলছে র্যানডম টেস্ট বা ভ্রাম্যমাণ গাড়ির মাধ্যমে ঘরে ঘরে ডোপ টেস্টের নতুন প্রযুক্তি সংযোজনের চিন্তা।
দেশে মাদক কমছে কিনা তার ইন্ডিকেটর বা সূচক সেট করার কথাও ভাবছে অধিদপ্তর। এ সংক্রান্ত এক সভায় সূত্র জানিয়েছে, এজন্য মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যা, মাদক-সংক্রান্ত মামলায় আসামির সংখ্যা, চিকিৎসার জন্য আসা মাদকসেবীর সংখ্যা, পারমিটধারীদের সংখ্যা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কথা বলা হয়। বৈঠকে আলোচনায় আরও বলা হয়, মাদকের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে কিনা বা মাদকের ক্রাইসিস (সংকট) আছে কিনা তা নির্ধারণ করা যেতে পারে। মাদকবিরোধী প্রচার-প্রচারণা বৃদ্ধি, দেশব্যাপী মাদক-সংক্রান্ত অভিযোগ বক্স স্থাপন করা যেতে পারে।
ডিএনসির উদ্যোগের মধ্যে আরও রয়েছে-নিরাময় কেন্দ্রগুলোকে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালুকরণ। এর অংশ হিসাবে লাইসেন্সপ্রাপ্ত সব মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে সিসিটিভি সংযোগ স্থাপন এবং আইপি সংযোগের মাধ্যমে প্রধান কার্যালয়ে ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম চালু করা হবে। ডার্ক নেট, ক্রিপ্টোকারেন্সি, মোবাইল অ্যাপস এবং সাইবার ক্রাইমবিষয়ক অভিজ্ঞ টিম গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বরের এক সভায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এছাড়া সিদ্ধান্ত হয়েছে ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট ডাটাবেজ তৈরির। মাদক ব্যবসায়ী (গডফাদার, পাইকারি, খুচরা ও পৃষ্ঠপোষক) এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের অনলাইন ডাটাবেজ তৈরির জন্য একটি সফটওয়্যার ডিজাইনও প্রস্তুত করা যেতে পারে বলেও এ সংক্রান্ত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়। এসবের পাশাপাশি গোয়েন্দা কার্যক্রম শক্তিশালীকরণে অস্ত্র, প্রযুক্তি, ট্র্যাকারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নির্ধারণের চিন্তাও চলছে।
উদ্যোগের মধ্যে আরও রয়েছে-মাদকপ্রবণ অঞ্চল নির্ধারণ করা। প্রয়োজনে যে অঞ্চলে মাদকপ্রবণতা কম সে অঞ্চল থেকে জনবল মাদকপ্রবণ এলাকায় পদায়ন করা হবে। অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শক থেকে তদূর্ধ্ব সবার পারফরম্যান্স বক্স চালু করা হবে। অনলাইন স্টাফ ডায়েরি সিস্টেমে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সেখানে প্রতিদিনের কাজের ইনপুট দেবেন। দৃশ্যমান ও জোরদার করা হবে মাদকবিরোধী প্রচার কার্যক্রম। স্কুল-কলেজ (বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম) এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকবিরোধী বিশেষ প্রচার-প্রচারণার পদ্ধতি ঠিক করা হবে। শিশু ও কিশোরদের জন্য মাদকবিরোধী কার্টুন, গেমস ও অ্যাপস তৈরি করা। এজন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটি শিশু-কিশোরদের উপযোগী করে কন্টেন্ট তৈরি করবে।
দেশব্যাপী মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজের অংশ হিসাবে ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা ও জেলাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিধিনিধিদের সঙ্গে অধিদপ্তরের সমন্বয় বৃদ্ধির কাজ চলছে। অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এর পাশাপাশি গঠন করা হবে প্রেস উইং। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের জন্য ইংরেজিতে পারদর্শী এবং যোগাযোগে সক্ষম এমন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত হবে এ উইং-যার দুটি শাখা থাকবে। একটি অভ্যন্তরীণ মিডিয়া ও আন্তঃসংস্থা সংযোগ স্থাপনে কাজ করবে। অপরটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও সংস্থা নিয়ে কাজ করবে।
ডিএনসি সূত্র জানায়, মাদক নিয়ন্ত্রণে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে থাকবে আইডিয়া ব্যাংক। সহকারী পরিচালক ও উপ-পরিচালকরা প্রতি ১৫ দিনে একটি করে এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তা, প্রসিকিউটর, পরিদর্শক, উপ-পরিদর্শক, সহকারী প্রসিকিউটর ও হিসাবরক্ষকরা প্রতি মাসে একটি করে আইডিয়া পাঠাবেন। প্রতিটি আইডিয়া হবে এক লাইনের এবং প্রয়োজনের ভিত্তিতে। যার যৌক্তিকতা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সঙ্গে দিতে হবে। আইডিয়া পেটেন্ট করতে হবে। চালু থাকতে হবে আইডিয়া ফ্যাক্টরি। অধিদপ্তরের প্রতিটি কার্যালয়কে ই-নথি ও ই-ফাইলিংয়ের আওতায় আনা হবে। ৩৭টি সেবাকে এক সেবায় অন্তর্ভুক্ত করে ডিজিটাল অফিস চালু করা হবে।
উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে অধিদপ্তরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের দীর্ঘ চাকরি জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর। সেজন্য তাদের রেখে সমাজের এলিট শ্রেণি ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে ‘থিংক ট্যাংক’ তৈরি হবে। এর বাইরে কেন্দ্রীয় রাসায়নিক পরীক্ষাগারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে গোপনীয়তা বজায় রেখে আন্তর্জাতিক মানের ড্রাগ মিউজিয়াম স্থাপন করা হবে। এজন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ আয়োজনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা, মডিউল ও ক্যালেন্ডার প্রস্তুতের কথাও বলা হয় এক সভায়।
এসব উদ্যোগ নিয়ে কথা হয় মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের উপদেষ্টা সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, যে পরিমাণ মাদক উদ্ধার হয় তার মোট মাদকের খুবই সামান্য। বেশিরভাগই থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। গণমাধ্যমের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, এখন মাদক ব্যবসায় জড়িত আছে ২৫০ থেকে ৩০০ গডফাদার ও ১ লাখ ৬৫ হাজার বিক্রির নেটওয়ার্ক। এদের মাধ্যমে মাদক খাতে বছরে লেনদেন হয় ৬০ হাজার কোটি টাকা। আর বেশ কিছু সংস্থার তথ্যানুযায়ী অবৈধ মাদক আমদানিতে প্রতি বছর বিদেশে পাচার হচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এদের চিহ্নিত করতে সময়োপযোগী পরিকল্পনার বিকল্প নেই। সেজন্য যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তা বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।