মৃত্যু সাগরে ডুবে, কর্তৃপক্ষ আর কত ঘুমাবে? ব্যারিস্টার পল্লব আচার্য আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট অফ বাংলাদেশ

- আপডেট টাইম : ১১:১৩:৪৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
- / ৬ ১৫০.০০০ বার পাঠক
বাংলাদেশ একটি পর্যটন সমৃদ্ধ দেশ, প্রতিটি জেলা উপজেলাতেই রয়েছে প্রকৃতির নিদর্শন তার মধ্যে অন্যতম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত যা বিশ্বের সব থেকে বড় স্যান্ডি ভিচ নামে পরিচিত।
প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক আসে কক্সবাজারে, সারি সারি ঝাউবন বালুর নরম বিছানা এবং সামনে বিশাল সমুদ্র যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।
কিন্তু এই সাগরের জলে মিশে আছে শত শত মানুষের স্বজন হারার কান্নার জল, তার কারণ একটাই সাগরে ডুবে মৃত্যু। যা কত কয়েক দশক ধরে আমরা শুনে আসছি “ নিজ দোষে দুর্ঘটনা” এই বলে সরকার, জেলা প্রশাসক, টুরিস্ট পুলিশ, পর্যটন মন্ত্রণালয় দায় এড়িয়ে যেতে পারে না।
সম্প্রতি ঈদের ছুটিতে কক্সবাজারে সাগরে গোসল করতে নেমে আমার চোখের সামনেই বাবা ও ছেলে একসাথে স্রোতের টানে ভেসে যায় যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে দুঃখের বিষয় হল কোন লাইফ গার্ড পাওয়া যায়নি উদ্ধার কার্যে অতঃপর স্থানীয় লোকের সহায়তায় বোটের মাধ্যমে উদ্ধার করা হলেও সাগর পাড়ে যখন আনা হয় তখন অজ্ঞান অবস্থায় মুখ দিয়ে ফেনা বেরতে থাকে এবং হালকা শ্বাস-প্রশ্বাস চলমান ওই অবস্থায় যদি কোন ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করলে আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি উক্ত ব্যক্তি কে বাঁচানো সম্ভব হতো, সৈকতে কোন মেডিকেল ক্যাম্প না থাকায় তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় যা (৩০) তিরিশ মিনিটের দূরত্ব। হাসপাতালে নেওয়ার পরে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ধরনের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ব্যাপারে আইনি যেসব ধারা রয়েছে তা দণ্ডবিধির ৩০৪ ও ৩০৪ (ক) ধারায় বর্ণিত অপরাধ। ৩০৪ এর (ক) ধারা হচ্ছে অবহেলা জনিত মৃত্যু অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি নরহত্যা বলে গণ্য নয়–এমন কোনো বেপরোয়া বা তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজ করে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটায়, সে ব্যক্তি পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সাগরে ডুবে যদি কেউ মারা যায় এবং তাকে বাঁচানো/ উদ্ধারের ক্ষেত্রে যদি পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হয় এবং অবহেলা থাকে তাহলে এই ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা যায়।
আর ৩০৪ ধারা হচ্ছে অপরাধজনক নরহত্যা। খুন নয় এমন শাস্তিযোগ্য নরহত্যার সাজা হচ্ছে, যে ব্যক্তি খুন নয় এমন শাস্তিযোগ্য নরহত্যা করে, সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা দশ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং পাশাপাশি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারে।
প্রথমত প্রতিবছর সাগরে ডুবে এত মৃত্যু পর্যাপ্ত পদক্ষেপ না নেওয়ার জন্য এবং দায়িত্বে অবহেলার জন্য ঘটেছে। দ্বিতীয়ত সাগরে ডুবে প্রতিবছর পর্যটক মারা যাচ্ছে এবং মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে এমনটি জানা সত্ত্বেও যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকে সেটা নরহত্যা বলেই বিবেচিত হবে। এটা ইচ্ছাকৃত খুন বা হত্যা নয়। কিন্তু সাগরে ডুবার পরে যদি যথাসময়ে উদ্ধার কার্য পরিচালনা করা না হয় এবং সমুদ্র সৈকতে প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকে –এটি নরহত্যার শামিল।
একজন সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী হিসেবে বলতে পারি সাধারণ মানুষের চোখে সাগরে ডুবে মৃত্যু একটি দুর্ঘটনা কিন্তু সেই দুর্ঘটনার ফলে প্রাণহানি হলে দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে দণ্ডবিধির ৩০৪ (ক) ধারায় দায়িত্বে অবহেলা জনিত মৃত্যুর দায় কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়। আর বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতে পর্যাপ্ত পরিমাণ লাইভ গার্ড এবং মেডিকেল ক্যাম্প না থাকা নরহত্যা (Culpable Homicide) বলে বিবেচিত হবে। দণ্ডবিধির ৩০৪ ধারা সে ক্ষেত্রে মামলায় যুক্ত হবে। অবশ্য কোন ধারায় বিচারে সোপর্দ করা হবে তা নির্ভর করে তদন্তের ওপর।
প্রথম আলো এর রিপোর্ট অনুযায়ী হোটেল-মোটেল কর্তৃপক্ষ ও টুরিস্ট পুলিশের হিসাবে, ঈদের ছুটিতে প্রথম দুই দিনে অন্তত আড়াই লাখ পর্যটক কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছেন। পরবর্তীতে এসেছেন আরও তিন লাখ মানুষ। ভ্রমণে আসা ৯০ শতাংশ পর্যটক সাগরে নামেন গোসল করতে। কিন্তু গত তিন দশকেও সমুদ্রের নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। পর্যটন খাত থেকে হোটেল-মোটেল মালিক এবং সরকার বিপুল টাকা আয় করলেও নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবাই উদাসীন। ১২০ কিলোমিটারের এই সৈকতের মাত্র ৫ কিলোমিটারে (কলাতলী থেকে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত) উদ্ধার তৎপরতা চালানো জন্য বেসরকারি একটি সংস্থার মাঝে ২৬ জন কর্মী রয়েছেন। অবশিষ্ট ১১৫ কিলোমিটার সৈকত অরক্ষিত পড়ে থাকছে। বিশেষ করে টেকনাফ, বাহারছড়া, পাটোয়ারটেক, ইনানী, হিমছড়ি, দরিয়ানগর, কলাতলী পয়েন্টের সৈকতে কেউ গোসলে নেমে নিখোঁজ হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর কেউ নেই।
পর্যটকের প্রধান আকর্ষণ থাকে সমুদ্রের পানিতে নেমে গোসল এবং বিকেলে বালুচরে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা। সৈকতকে ঘিরে গত দুই দশকে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে উঠেছে ছয় শতাধিক বহুতল ভবনের হোটেল রিসোর্ট গেস্টহাউসসহ নানা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু কেউ কয়েক লাখ টাকা খরচ করে সমুদ্রের পানিতে সি নেটিং সিস্টেম গড়ে তুলে পর্যটকের নিরাপদ গোসলের ব্যবস্থা করতে কেউ আগ্রহী নয়। অরক্ষিত সৈকতে গোসলে নেমে কোনো পর্যটক মারা গেলে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও নেই।
লাশ ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতেও পর্যটকের পকেটের টাকা খরচ হয়। অথচ সৈকতের ছাতা-চেয়ারের (কিটকট), বিচ বাইক, ঘোড়া, দোকানপাটসহ নানা ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বাধীন বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি প্রতিবছর মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করেন।
জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব ও কার্যাবলী ২০১১ এর সূচিপত্রের ৬ নাম্বারে পর্যটন বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং ৬(৩) বলা হয়েছে বিদ্যমান পর্যটন স্পটগুলোতে আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধানে উদ্যোগ গ্রহণ; এখানে প্রশ্ন হল শুধু ২৬জন উদ্ধারকর্মী দিয়ে কি লাখ লাখ পর্যটককে নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপদে গোসলের ব্যবস্থা করানো কি সম্ভব? পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য স্থায়ীভাবে একটি মেডিকেল ক্যাম্প কেন নয়?
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করা জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব ও কার্যাবলীর বিধানের কি লঙ্ঘন নয়। শুধুমাত্র সমুদ্র সৈকতে লাল পতাকা দেখিয়ে এই দায় এড়িয়ে যাওয়া কি সম্ভব?
এটা কি কর্তব্যের লঙ্ঘন নয় ( Breach of duty of care) duty of care বলতে বুঝায় In tort law, a duty of care is a legal obligation requiring individuals to act reasonably and avoid causing foreseeable harm to others. ( টর্ট আইনে, যত্নের কর্তব্য হল একটি আইনি বাধ্যবাধকতা যার জন্য ব্যক্তিদের যুক্তিসঙ্গতভাবে কাজ করতে হবে এবং অন্যদের পূর্বাভাসযোগ্য ক্ষতি এড়াতে হবে)
পরিশেষে এটা বলতে পারি হয়তো সী নেটিং, মেডিকেল ক্যাম্প এবং পর্যাপ্ত লাইফ গার্ড থাকলে প্রতিবছর লাখ লাখ পর্যটক সমুদ্র ভ্রমণে এসে স্বজন হারার কান্না নিয়ে ফিরতে হতো না। আর যদি কোন দুর্ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা।