আমতলীর মেয়রের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এলাকার মানুষ কথার বাইরে গেলেই নির্যাতন * রেহাই নেই দলীয় নেতাকর্মীদেরও
- আপডেট টাইম : ১২:৩১:৫৩ অপরাহ্ণ, সোমবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
- / ১২৪ ৫০০০.০ বার পাঠক
বরগুনার আমতলী পৌরসভার মেয়র ও তার পরিবারের অত্যাচার-নির্যাতনে অতিষ্ঠ এলাকার লোকজন। তার অত্যাচার থেকে রেহাই পান না দলীয় কর্মী-সমর্থকরাও। নিজের মত কিংবা স্বার্থের বিরুদ্ধে কেউ গেলে তার ওপর সন্ত্রাসী বাহিনী লেলিয়ে দেন মেয়র। এসব নিয়ে কারও টুঁ-শব্দ করারও সাহস নেই। এসব সন্ত্রাসী ঘটনায় পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। বাধ্য হয়ে এক ভুক্তভোগী আদালতের আশ্রয় নিলে বিচারক মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা নেওয়ার নির্দেশ দেন। পরে থানায় মামলা হয়।
জানা যায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান এক সময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ২০২১ সালের পরবর্তী সময় বিএনপির এমপির খুব কাছের লোকও ছিলেন। সে সময় অনেকে নির্যাতনের শিকার হন মতিয়ার রহমানের হাতে।
২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের পর মতিয়ার ভোল পালটে হয়ে যান আওয়ামী লীগার। এরপর নানা কৌশলে আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর আস্থাভাজন হয়ে যান। বাগিয়ে নেন আমতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদও।
২০১১ সালে পৌর নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হন মতিয়ার। ২০১৯ সালে উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হন।
মেয়র ও আওয়ামী লীগের পদ অপব্যবহার করে মানুষের ওপর অন্যায়-অবিচার চালিয়ে যান বিনা বাধায়। ৩০-৩৫ জনের একটি কিশোর গ্রুপ দিয়ে নিজ মতের লোকদের শায়েস্ত করেন। তার ক্ষমতার দাপট, হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে দলের অনেক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ বাড়ি-ঘরছাড়া হয়েছেন।
গত ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় মেয়রের ভাইয়ের নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন খানকে কুপিয়ে জখম করে। এ ঘটনার প্রতিবাদে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠলে গা-ঢাকা দেয় সন্ত্রাসীরা। পরে মোয়াজ্জেম খানের ভাতিজা মো. কবির খান পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান ও তার ভাই ভারপ্রাপ্ত উপজেলা চেয়ারম্যান মজিবুর রহমানসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে আমতলী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগ করলে বিচারকের নির্দেশে ৩ সেপ্টেম্বর থানায় মামলা হয়।
উপজেলা যুবলীগের সভাপতি জিএম হাসান জানান, মোয়াজ্জেম হোসেন খান স্কুলজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এর আগেও কয়েক দফা তার ওপর হামলা চালানো হয়। পান থেকে চুন খসলেই মেয়র সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে বিরোধী শিবিরের নেতাকর্মীদের লাঞ্ছিত করেন।
জমিজমাসংক্রান্ত বিরোধের জেরে গত ৭ ফেব্রুয়ারি পিয়াল তালুকদার ও জুলাই মাসে পৌর শ্রমিক লীগ সভাপতি সজীব প্যাদার ওপর হামলা চালায় মেয়র বাহিনী। হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সজীব প্যাদা বলেন, ‘মেয়রের পালিত সন্ত্রাসীরা আমাকে মেরে হাত ভেঙে দিয়েছে। বিচার পাই না, তাই কারও কাছে বিচার চাইও না।’
এছাড়া ২০২২ সালের ৪ আগস্ট ঠিকাদার নাজমুলকে কুপিয়ে জখম করা, ঠিকাদারি কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন করায় দুলাল বয়াতিকে মেরে হাত ভেঙে দেওয়া, সম্পত্তি দখলে বাধা দেওয়ায় ২০২১ সালে কালাম নামে এক ব্যক্তির ওপর কয়েক দফা হামলা, সম্পত্তি দখলে ব্যর্থ হয়ে ২০১৫ সালে কার্তিক মন্ডলের ওপর হামলা ও মিথ্যা মামলা দায়ের; চাঁদা না দেওয়ায় ২০১৮ সালে মশিউর আকনের বিল্ডিং গুঁড়িয়ে দেওয়া, জমি দখলে বাধা দেওয়ায় কামাল আকনকে মারধর, ২০১৯ সালে শ্রমিক লীগ সভাপতি মিন্টু মল্লিকের ওপর হামলা, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন ফকিরকে মারধর করে জমি দখল, জমি দখলে বাধা দেওয়ায় ২০২১ সালে পৌর ছাত্রলীগ সভাপতি জুয়েল গাজী ও যুবলীগের সহসম্পাদক ফাহাতকে কুপিয়ে জখম; নৌকার এজেন্ট থাকার অপরাধে যুবলীগ নেতা অ্যাডভোকেট মঈন, ছাত্রলীগ নেতা সোহেল ও ইউসুফ মাস্টারকে কুপিয়ে আহত করা; নিজাম বয়াতির হাত-পা ভেঙে দেওয়া; যুবলীগ নেতা আইয়ব গাজী, ছাত্রলীগ সভাপতি রিয়াজ মৃধা এবং মহিলা আওয়ামী লীগের সম্পাদিকা জোছনাকে কুপিয়ে জখম এবং আওয়ামী লীগ অফিসের পিয়ন শান্তি মিস্ত্রিকে মারধর শেষে উলঙ্গ করে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা-এ ধরনের অসংখ্য অপরাধের নায়ক মতিয়ার।
এছাড়া ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির ছেলে শাহিনকে নিজে মারধর করেন মেয়র। শাহিন পানি খেতে চাইলে মেয়র তাকে প্রস্রাব পান করতে দেন। ২০২০ সালে ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুরাদ ও পারভেজকে মেয়র নিজে ফিল্মিস্টাইলে তুলে নিয়ে মারধর করে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালের শেষের দিকে আমতলী থানায় তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ সভাপতি জিএম দেলোয়ারকে লক্ষ্য করে মেয়র গুলি করেন। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান উপজেলা চেয়ানম্যান। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা নং ১১৭৯/১৬।
২০১২ সালে উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি নিরুপম দে ও তার ভাই দ্বীপক দে’র ওপর হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘যুবলীগ নেতা নিরুপম ও দ্বীপককে বিদ্যুতের খাম্বার সঙ্গে বেঁধে মেয়র ও তার বাহিনী নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়ে দুই সহোদর। এর কয়েক মাস পর মারা যান নিরুপম। তার ভাই এখনো অসুস্থ।’
এমইউ উচ্চ বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন, কৃষি র্কমকর্তা জব্বার মল্লিক, উপজেলা পরিষদের ড্রাইভার আল-আমিন, আমতলী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মজিবুর রহমান, গুলিশাখালী মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত সুপার মাওলানা মন্নান, কাওনিয়া স্কুলের সহকারী শিক্ষক ফজলু খলিফা, মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তাফা ও খেকুয়নী স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বপন মিয়াকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ রয়েছে মেয়র ও তার পালিত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় জনৈক এক ঠিকাদার জানান, বিএনপি‘র আমলে এক উপজেলা প্রকৌশলীকে মারধরের অভিযোগে কারাভোগ করেন মতিয়ার রহমান। ২০২১ সালে আমতলী থানার এসআই সোহেল রানা ও এসআই সাহাবুলকে প্রাণনাশের হুমকি দেন। এ ঘটনায় থানায় জিডি করেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে আমতলী পৌরসভার মেয়র মতিয়ার রহমান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ থেকে ঝরে পড়া একটি গ্রুপ। এসব অভিযোগ তারই অংশ। আমাকে রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করতে এসব করা হচ্ছে।’ ‘মতিয়ার রহমান ২০০১ সালের পর বিএনপিদলীয় এমপির কাঁধে ভর করে আ.লীগ কর্মীদের ওপর হামলা-মামলা চালাত আর এখন আপনার কাঁধে ভর দিয়ে দলীয় কর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালাচ্ছে’-এমন প্রশ্নের জবাবে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু যুগান্তরকে বলেন, ‘ঠিক আছে জানি সব। এমন প্রশ্ন না করাই ভালো। এ অবস্থা সর্বত্র; কী করবেন আপনি? সব ঠিক হয়ে যাবে।