মারামারি’ শিখতে এসে তিনি এখন ‘কারাতে মাস্টার’ কারাতে কম দেয়নি হোসেন আলীকে—বাঁচতে শেখার পাশাপাশি

- আপডেট টাইম : ০২:০৭:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২১ জুন ২০২৫
- / ৪ ১৫০.০০০ বার পাঠক
লড়তে শিখিয়েছে— সংগৃহীত ছবি
আর দশজন ছেলের মতো মো. হোসেন আলীও ছিলেন ডানপিঠে। পড়াশোনা পাশে রেখে চলত খেলাধুলা-হুড়োহুড়ি। কারাতে-কুংফু মুভির প্রতি ঝোঁক তখন বিস্তর। বন্ধুদের সঙ্গে কখনো হাতাহাতিও হয়ে যেত। একদিন মনে হলো, ‘কারাতে শিখলে মারামারিতে ভালো করব। মার কম খাব, দেব বেশি।’ সেই ভাবনা থেকেই প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া।
ওখান থেকেই শুরু, এখনো চলছে। শখের কারাতে খেলাটাই হয়ে বসে পেশা। ৩৮ বছর কেটে গেছে, কারাতে এখনো শুনছে তার কথা। হোসেন আলীর পরিচয় দৈর্ঘ্যে-প্রস্তে বেড়েছে বহুগুণ। তিনি এখন কারাতে মাস্টার। গোল্ড মেডেলিস্ট। কারাতের দুই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মেয়ের বাবা। একজন প্রশিক্ষকও।
মো. হোসেন আলী এখন কারাতে মাস্টার। গোল্ড মেডেলিস্ট। কারাতের দুই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মেয়ের বাবা। একজন প্রশিক্ষকও।
আত্মরক্ষার জন্য কারাতে খেলতে আসা হোসেন আলী ইন্টারন্যাশনাল হোপ স্কুলে তরুণদের প্রশিক্ষণ দেন। অ্যাডহক কমিটির সদস্যও। ন্যাশনাল ক্যাম্পে জাতীয় দলে কোচ হিসেবেও আছেন। ৩৮ বছরের ক্যারিয়ারে পেছনে তাকিয়ে হোসেন আলী হাসেন সুখের হাসি। দুই মেয়ের পাশাপাশি শত তরুণকে শেখান খেলাটি। আত্মরক্ষার পাশাপাশি কঠিন সময়ে দীক্ষা দেন টিকে থাকার মানসিকতা, অপরাধ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই আর অসীম সাহসিকতা। কারাতে নিয়েই বাঁচেন হোসেন আলী।
গল্পে গল্পে বলেছিলেন এই খেলায় আসার কথা, ‘ছোটবেলা থেকে ডানপিটে ছিলাম। মারামারি করতাম। কুংফু-কারাতের সিনেমা দেখতাম। ওখান থেকেই উৎসাহ পেলাম যে মারামারি আরও ভালো করব। সেই ভাবনা থেকেই টিচারের ক্লাবে ভর্তি হই। তিনি আমাকে তখন টুর্নামেন্টে নামিয়ে দেন। ওই সুযোগেই আমি ন্যাশনাল মেরে (জিতে) দিলাম। ওখান থেকে যাত্রা শুরু। এরপর আমি আনসার টিমে ঢুকি। ১৯৮৮ সালে গোল্ড জেতার পর আনসার আমাকে নিয়ে নেয়। ২০০৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ আনসার টিমে খেলি। খেলোয়াড়ি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমি ছিলাম জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। মাঝখানে গ্যাপট্যাপ গেছে কিছু।’
দুই মেয়ে মিম ও মিথি এসেছেন কারাতেতে, হয়েছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন— সংগৃহীত ছবি
কারাতে তাকে কম দেয়নি—বাঁচতে শেখার পাশাপাশি লড়তে শিখিয়েছে। দিয়েছে সম্মানজনক পেশাও। হোসেন আলীর প্রশিক্ষিত চোখ বলছে, ভবিষৎতে এই খেলাটির দাম বাড়বে, মান বাড়বে। সেই নিয়ে নিরলসভাবে কাজও করছেন তিনি। ক্রিকেট-ফুটবলের বাংলাদেশে কেন কারাতে ঝুঁকবে একজন তরুণ, এমন প্রশ্নের জবাবে চ্যাম্পিয়ন হোসেন আলী শুনিয়েছেন প্রত্যয়—দেখিয়েছেন বাস্তবতা, ‘আমাদের দেশে যারা কারাতে শেখে, তারা মূলত আত্মরক্ষার জন্য শেখে। সেল্ফ ডিফেন্স আমাদের দেশে এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তাই শক্তি আনার জন্য, সাহস জোগানোর জন্য অনেকেই কারাতেতে ঝোঁকে। এটি এখন স্পোর্টসে চলে গেছে। দরিদ্র পরিবার হলে এখান থেকে অর্থও পেতে পারে। আনসার, আর্মি বা অনেক টিম আছে যারা ডাকে—খেলার জন্য বা চাকরির জন্য। এটা একটু সহজ। একজন মধ্যবিত্ত ছেলের জন্য ক্রিকেটের খরচ পোষানো কঠিন হয় কখনও কখনও। তাছাড়া খেলা নিয়েও শঙ্কা থাকে। কিন্তু কারাতেতে তেমন দরকার হয় না। উল্টো জব সিকিউরিটি থাকে। কারাতে চাইলে আত্মরক্ষার জন্যও শিখতে পারে, খেলতেও পারে। পড়াশোনায় তেমন ক্ষতি হয়না। সরকারও ইতোমধ্যে সাহায্য করছে।’
নিজের দুই মেয়ে রাবেয়া সুলতানা মিম ও হুমায়রা সুলতানা মিথিও আছেন কারাতের সঙ্গে। দুজনেই জাতীয় পর্যায়ে গোল্ড মেডেলিস্ট। খেলছেন, পড়াশোনার পাশাপাশি কোচিংও করাচ্ছেন। এমন দুই সন্তানের পিতা হয়ে কেমন লাগে? হোসেন আলীর কাছে এটি একটু বেশিই গর্বের।
বাবা হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। আমার দুই মেয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট। বাংলাদেশে বোধহয় আর এমন কেউ নেই। বাবা গোল্ড পাইছে, মেয়েরাও পাইছে—এমন নাই।
কারাতে মাস্টারের ভাষ্যমতে, ‘বাবা হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। আমার দুই মেয়ে গোল্ড মেডেলিস্ট। বাংলাদেশে বোধহয় আর এমন কেউ নেই। বাবা গোল্ড পাইছে, মেয়েরাও পাইছে—এমন নাই। এজন্য বেশি গর্ব লাগে। আত্মরক্ষার পাশাপাশি ওরা অর্থও পাচ্ছে। স্বচ্ছল হতে পারছে।’
কারাতে নিয়ে আক্ষেপ আছে হোসেন আলীর। এই খেলাটির গুরুত্ব বেশি। কিন্তু প্রচারণা কম। স্পন্সর পাওয়া যায় না। খেলোয়াড়দের নার্সি নিয়েও সমস্যা। তবে সেই সব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে সরকার। নিরান্তর কাজ করে যাচ্ছেন হোসেন আলী এবং অন্যরা। কারাতে ফেডারেশনও তৃণমূলের খেলোয়াড় তুলে আনছে। হোসেন আলীর বিশ্বাস, এই খেলাটি দেশে ও বিদেশে বাংলাদেশের সম্মান আনবে। সেটি হলেই তো চ্যাম্পিয়ন হোসেন আলীর আরেকটি স্বার্থকতা।