ওভারটাইম আর নাইট বিলের টাকায় গড়েছেন 📖 সবার জন্য পড়া উন্মুক্ত পাঠাগার
- আপডেট টাইম : ১০:৪৬:০০ পূর্বাহ্ণ, বুধবার, ১৫ জানুয়ারি ২০২৫
- / ১ ৫০০০.০ বার পাঠক
আমার আজও মনে পড়ে, ছোটবেলা থেকে নতুন বইয়ের গন্ধ প্রচন্ড ভালোবাসতাম, যা আজও বিন্দুমাত্র কমলো না। গাছ ও পানির অপর নাম যদি হয়ে থাকে জীবন, তাহলে চোখের আপর নাম দৃষ্টি। আমার কাছে বইয়ের আপর নাম আলো। জীবনের পদে পদে ঘন কুয়াশা ভেদ করে আলোর ছটা ছড়ায় যে সূর্য তার নাম বই। বইয়ের জগতে যে একবার প্রবেশ করছে একনিষ্ঠাভাবে সেই কুড়িয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতব মণিমুক্তা। আমি এক’জন বইয়ের ক্ষুদ্র গ্রাহক, পাঠক ও সংক্ষরক।
আমার আব্বাজান এবং মরহুম দাদাজানও ছিলেন বইয়ের পোকা। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের জন্য করে গেছেন জমি দান সহ আরও অনেক অনেক মহৎ কাজ। যে কাজের জন্য গ্রামের মানুষের মাঝে আমার বাবা ও দাদার নাম শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথেই আলাপ-আলোচনায় উঠে আসে। তাদের সন্তান ও নাতি হিসাবে আন্ধকারে আলো ছড়িয়ে দিতে লড়াই’টা শুরু করে ছিলাম ২০০৮ সালের ১ পহেলা জানুয়ারি, দিন’টি ছিল মঙ্গলবার। একটি ক্ষুদ্র পরিসর থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম ৷ আমাদের যাত্রা ক্ষুদ্র পরিসর থেকে হলেও আশা ছিল অনেক বড়ো। স্বপ্ন বুনে ছিলাম বিশাল হৃদয় দিয়ে। আমাদের আশা ও স্বপ্ন জুড়ে ছিল আন্ধকারে আলো ছড়ানোর মতো। সেই আশাকে ধারণ করেই এক অজপাড়া গাঁয়ের ইছামতি নদী ও নজরুল সড়কের পাশে জরাজীর্ণ একটি বাঁশের মাঁচালে গ্রামের কিছু মুড়িব্বিদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হয় পাঠাগারের নাম ও মের্ধা বিকাশে সোনালী স্লোগান।
পড়িলে বই আলোকিত হই, না পড়িলে বই অন্ধকারে রই ৷ এই স্লোগানের মাধ্যমেই প্রতিষ্টাতা করি পাঠাগারটি। দিনের অনেকটা সময় এখন পাঠাগারে ব্যয় করি আমি ৷ নিজ বাড়ির উঠানে ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের একটি ঘরের ভেতরে ০১টি টেবিল ও ১২টি চেয়ার বসে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে। তবে কোনোটাই পাঠ্যবই নয়। কেউ ইতিহাস, কেউ সাহিত্য, কেউ ইসলামিক বই, কোরআনের মানচিত্র, আল-কোরআনের ভাষা, কেউ মিনার, মুনছুর স্যারর কবিতার বই, কেউ কালবেলা, মধুময় পাল স্যারের লেখা বই, কেউ পড়ছে আলোকিত মানুষ, কেউ পড়ছে উপন্যাস, কেউ গল্পের বই, আবার কেউ মনীষীদের জীবনীগ্রন্থ। আর কাঠের একটি বড় বুক-সেল্ফে থরে থরে সাজানো ১,০০০-১,২০০ শতের অধিক বই। পাঠাগারের নাম ‘সবার জন্য পড়া উন্মক্ত পাঠাগার’। একজন চাকরি জীবির নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা। বর্তমানে পাঠাগারটি পরিচালিত হচ্ছে স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল, হাইস্কুল ও কলেজ পড়ুয়া এক ঝাক তরুন-তরুনী শিক্ষার্থীর তত্ত্বাবধানে। তাদের সহযোগীতায় সদস্য হওয়া, বই নেওয়া, বই ফেরত দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রম তারা পাঠাগারের রেজিস্টারে লিপিবদ্ধি করে রাখেন।
পাবনা জেলা শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাঁথিয়া উপজেলার থেকে ১০ কিলোমিটার দুরে ধুলাউড়ি ইউনিয়ন এর ধুলাউড়ি গ্রাম। সেই গ্রামে বাড়ি আমার। বিকেএসপিতে চাকরি করার সময় আমিনুল হক বুলবুলের ক্রিকেট খেলা শিক্ষা বই পড়ার মাধ্যমে বই পড়ার জগতে প্রথম প্রবেশ শুরু হয় ২০০৭ সালে এবং বিকেএসপির চাকরি ছেড়ে নারায়নগঞ্জ মেগনার ঘাট মেঘনা গ্রুপে জয়েন্ট করি ইনিঃ মোঃ আওসান হাবিব স্যারের মাধ্যমে ২য় বই বেসিক ইলেকটিক্যাল ইন্টারভিউ নজেল বই পড়ার মাধ্যমে কর্ম জীবনে যেমন সফল্য আসে বই পড়ার প্রতি আরাও বেশি আসক্তি হয়ে পড়ি। এই ভাবে দু’একটি করে বই কিনে পড়তে পড়তে এক সময় আমার কাছে ৪০০-৫০০ শত বই জমা হয়ে যায় ৷ এই সব বই যে পড়েছি তা কিন্তু নয় ৷ যাই হোক ২৫০-৩০০ পিস বই রয়ে যায় উত্তরাতে এবং ২০২১ সালের ০১ জানুয়ারিতে নিজ গ্রামে ২৫০ পিস বই নিয়ে যখন পাঠাগারটি আনুষ্ঠানিক ভাবে চালু করি। পরে বন্ধু, সহপাঠী, পাড়া–প্রতিবেশী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে সহায়তা চাইলে তাঁরা ব্যাপক সাড়া দেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বর্তমানে বই সংখ্যা এখন ২,২৬৩ টি ৷চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে আছি। এবিএফ ফাউন্ডেশনের কেন্দীয় প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। এছাড়া প্রতিষ্ঠাতা- বয়লার অপারেটর গ্রুপ৷ যার মাধ্যমে প্রতি মাসেই দুই চার পাঁট জন্য চাকরির ব্যবস্থা করে থাকি।
পাঠাগার তৈরির ইচ্ছাটা আমার ছোটবেলা থেকেই। চাকরি সুবাধে হাবিব সাহেবের উপহার দেওয়া বই ‘বেসিক ইলেকটিক্যাল ইন্টারভিউ নজেল’ পড়েই জানতে পারেন পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার রয়েছে, তা সেদিনই তাঁর সামনে উন্মোচিত হয়। তিনি বলেন, ‘অফিস ছুটির পর প্রায় দিনই বাসায় গিয়ে বই পড়তাম। এভাবেই অভ্যাস গড়ে ওঠে। কিন্তু গ্রামে ছেলেমেয়েদের জন্য বই পড়ার তেমন কোনো সুযোগ–সুবিধা নেই। তখন থেকেই মনে হতো গ্রামে একটি পাঠাগার করতে পারলে সবাই বই পড়ার সুযোগ পাবে।’
প্রতিদিন অফিস যাওয়া-আসা ও টিফিন বিল জমা করে ও মাস শেষে বেতন তুলে আরোও নতুন নতুন বই কেনা ও পড়া শুরু করি। অন্যদিকে মাস শেষে বাঁকি টাকা বাবাকে পাঠাই৷ গ্রামের কৃষক পরিবার আমাদের। বাবা নিজ জমিতে কৃষি কাজ করে যা আয় হত তা দিয়েই মা ও চার বোন ও আমাদের সংসার চলে। আমি যখন ৫ম শ্রেণীর ছাত্র তখন হঠাৎ করেই মা অসুস্থ্য হয়ে মারা যায়। তখন পড়া লেখার পাশা-পাশি বাবার সাথে জমিতে কাজ শুরু করি ৷ এই ভাবে চলতে ছিলো কিন্তু বাবা আবার ২য় বিবাহ করলেন। তখনও ভালোই চলছিলো তবে যখন ৭ম শ্রেণীর ছাত্র তখন থেকে বাবা ও সৎ মায়ের আচার-আচারণ কেমন যেন পরিবর্তন হতে শুরু করে। আমি যখন ৮ম শ্রেণীতে পড়ি তখন বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হই৷ এরপর পরিচিত এক ভাইয়ের মাধ্যমে প্রথম চাকরি শুরু করি বিকেএসপিতে সেখান থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে বইয়ের পেছনে ব্যয় করা শুরু করি। এভাবেই ধীরে ধীরে নিজের সংগ্রহে অসংখ্য বই জমা হতে থাকে। পাঠাগারের জন্য আসবাব, বই রাখার বুক-সেল্ফ ও প্রয়াজনীয় সবই কিনেছি নিজের টাকায়। ‘করোনার সময় শুরুর দিকে কর্মস্থল বন্ধ হয়ে গেলে গ্রামের চলে আসি। গ্রামের সকল মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী ও সকল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বেশির ভাগ মানুষ ফেসবুক, ইমু, টিকটক, লাইকি, ভিডিও গেইমসহও বিভিন্ন বিষয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রযুক্তিকে যেমন বাদ দেওয়া যাবে না, তেমনি বই পড়াকে ত্যাগ করা যাবে না। কারণ বই আপনার অজ্ঞাতার প্রাচীর ডিঙিয়ে জ্ঞানের আলোয় আপনাকে করবে আলোকিত মানুষ। তাই এ কথা মাথায় রেখে চিন্তা করতে থাকি কীভাবে সবাইকে আবারও বইমুখী করা যায়। একদিন মনে হলো আমার কাছে যত বই আছে, সেগুলো দিয়ে একটি পাঠাগার শুরু করা সম্ভব। সবার সঙ্গে কথা বললাম, মোঃ মোনাইম খাঁন কাকা তাতে সায়ও দিয়েছেন। তারপর পাড়ার সবাই’কে নিয়ে বসে পাঠাগারের নাম ঠিক করা হয়। তারপর আমার পরিচিত অনেকে বই দিয়েছেন। এভাবেই পথচলা শুরু ও এখনো চলছে।
পাঠাগারের শিশুতোষ গ্রন্থ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য, বিনোদন, রাজনীতি, অর্থনীতি, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রচনাসমগ্র, জীবনী, ছোটগল্প, কবিতা, ভাষাতত্ত্বসহ সাহিত্যের সব ধারার বই রয়েছে। প্রতিদিন আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১০-১৫ জন পাঠক এসে নিয়মিত বই পড়েন ও নিজ বাড়িতে বই নিয়ে পড়ার সুযোগ পান।
পাঠাগার’টির আরেক সদস্য তেজগাঁও কলেজের ছাত্র সুমন বলেন, আমাদের গ্রামের মানুষের জন্য কিংবা ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আশেপাশে তেমন কোন পাঠাগার না থাকায় বই পড়তে হলে আমাদের ৩৫-৪০ কিলোমিটার দূরে পথ পাড়ি দিয়ে জেলা সরকারি গ্রন্থগারে যেতে হয়। যা আমাদের জন্য অনেক কণ্ঠসাধ্যও দুরহ ব্যাপার। কিন্তু “সবার জন্য পড়া উন্মক্ত পাঠাগার” থাকায় আমরা যখন খুঁশি তখন যে কোন ধরণের বই পড়ে আনান্দিত হতে পারি ও জ্ঞান আরোহণ করে থাকি।
পাঠাগার’টির সহযোগীতায় থাকা Alif BoilerCompany এমডি জি এম ইলিয়াস হাসান বলেন, পাঠাগার’টি ধুলাউড়ি ইউনিয়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে পাঠ্যভ্যাস তৈরীতে ব্যাপক ভুমিকা রাখছে। পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বই পড়েন শিক্ষার্থীরা। পাঠাগারটিতে জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করছে, যা তাদের ভবিষ্যতে আলোকিত মানুষ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। তাই পাঠাগারটির উন্নয়নে সমাজের শিক্ষানুরাগী ও বিত্তবানদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহবান জানাচ্ছি।
সবার জন্য পড়া উন্মুক্ত পাঠাগার
স্থানঃ ধুলাউড়ি পূর্বপাড়া, ধুলাউড়ি, সাঁথিয়া, পাবনা-৬৬৫০।