সারা বিশ্বে মুসলিম উম্মার জন্য সালাতুত তারাবি: একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা
- আপডেট টাইম : ০১:৩৩:৪৩ অপরাহ্ণ, সোমবার, ১ এপ্রিল ২০২৪
- / ৬৯ ৫০০০.০ বার পাঠক
তারাবির পরিচয়: হাফেজ মাওলানা হারুনর রশিদ বলেন: তারাবিহ শব্দটি তারবিহাতুন এর বহুবচন। তারবিহাতুন অর্থ একবার বিশ্রাম গ্রহণ করা। যেমন: তাসলিমাতুন অর্থ একবার সালাম দেয়া। মাহে রামাযানের বরকতময় রজনীতে জামাতের সঙ্গে যে নামায পড়া হয় তাকে তারাবি বলে। (ফাতহুল বারী, কিতাবু সালাতিত তারাবি ৪/২৯৪)
আল মানার প্রণেতা বলেন: তারাবিহ বহুবচন; একবচন তারবিহাতুন, অর্থ বসা, তারাবির নামাযে প্রতি চার রাকাত অন্তর বসা।
তারাবির আভিধানিক অর্থ: তারাবি আরবী শব্দ। মূলধাতু রা-হাতুন; অর্থ প্রশান্তি। অন্যতম ধাতু রাওহুন। সন্ধারাতের প্রশান্তি বা প্রশান্তির বৈঠক; যা রামাযান মাসে তারাবীহর নামাযে প্রতি চার রাকাত পরপর করা হয়ে থাকে।
বহুবচন:‘তারাবি’ প্রশান্তির বৈঠক সমূহ। (আল মুনজিদ)
নামকরণ: যখন থেকে সাহাবায়ে কেরাম এ নামায সম্মিলিতভাবে আদায় করতে আরম্ভ করেন তখন থেকেই তাঁরা প্রতি দু’সালামের পর (চার রাকাতের পর) বিশ্রাম নিতেন। তাই এ নামাযের নাম তারাবি বলে করা হয়েছে। (ফাতহুল বারী)
তারাবির গুরুত্ব ও ফযিলত: হাদিসের ভাষ্যানুযায়ী আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য অর্জনের প্রধান মাধ্যম হল ফরয ইবাদত ও ফরয দায়িত্ব সমূহের ব্যাপারে যতœবান হওয়া। অতঃপর সুন্নত ও নফলের মাধ্যমে যে পর্যায়ের নৈকট্য লাভের কথা হাদিসে এসেছে তাও অন্তরকে জাগ্রত করার জন্য এবং মানবাত্মাকে ব্যাকুল করার জন্য যথেষ্ট। যার সারাংশ হল ইখলাসে নিয়তের সাথে সুন্নত ও নফলের প্রতি মনোযোগি হলে বান্দার রুচি ও স্বভাব দুরুন্ত হয়ে যায়। ফলে রেজায়ে খোদাওন্দীই হয় তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য। তার প্রতিটি আমাল হয় প্রভু সন্তুষ্টির অনুগামী। তার প্রতি থাকে খোদায়ী মহব্বত। এ ব্যাপারে ইরশাদ হচ্ছে- ‘কেউ যদি আমার ওলী (বন্দুর) সাথে দুশমনি করে তবে আমি তার সাথে যুদ্ধ ঘোষণা দিচ্ছি। (সহিহ বুখারী: ১১/৩৪০-৩৪১ ফাতহুল বারী, মাজমাউল ফাতাওয়া: ১৮/১২৯-১৩১
রামাযানুল মুবারক হচ্ছে রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের বসন্তকাল। এর বাস্তবাবস্থা শব্দ ও বাক্যের কথা মালায় প্রকাশ করা অসম্ভব। মহান রাব্বুল আলামিন কোরআনে কারিমে দ্বারা রামাযানে রোযা রাখার ফরযিয়াত ঘোষণা করেছেন এবং বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা:)’র পবিত্র যবানে ‘কিয়াম’ যাকে কিয়ামে রামাযান বা তারাবি বলে। সুন্নত বানিয়েছেন। বিভিন্ন হেকমত এর ভিত্তিতে সুন্নতে মুআক্কাদাহ রাখা হয়েছে। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই যে, রামাযানের পূর্ণ বরকতের সাগরে গা ভেজাতে হলে তারাবির ব্যাপারে অবশ্যই যতœবান হতে হবে। এ কারণেই মুমিন বান্দা রামাযান ও কোরআনের হক আদায়ের জন্য, রোযার মাধ্যমে তাক্বওয়া হাসিলের জন্য, আল্লাহর অফুরন্ত রহমত ও মাগফিরাতের রারিধারায় সিক্ত হওয়ার জন্য, খোদায়ী মহব্বতের হক আদায়ের জন্য, সর্বোপরি আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সালাতুত তারাবিতে মগ্ন হয়ে থাকে।
পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে ও পূণ্যতা লাভের আশায় এবং বিনয় ও নম্রতার সাথে রামাযানের রাত সমূহে (নামাযে) দাঁড়ানো ও সেজদায় মাথা অবনত রেখে সময় কাটাতে থাকে এবং এর মাধ্যমে মহান প্রভুর সাথে দীর্ঘক্ষণ একান্ত আলাপচারিতায় প্রভু প্রেমের তৃঞ্চা নিবারণ করে ক্বলবের পরিতৃপ্তি লাভে সক্ষম হয়।
এ থেকে তারাবির গুরুত্ব দিবালোকের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সুন্নত ও নফলের সাধারণ নিয়মের বাইরে ফরয নামাযের মত জামাত হয়েছে। তবে রাসূলে মাক্ববুল (সা.) নিজে জামাতের ব্যবস্থা এ জন্য করেননি যে, তা যদি আবার উম্মতের উপর ফরয হয়ে যায়। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সালাতুত তারাবির মাকাম সাধারণ নফল ও অন্যান্য সুন্নত থেকে উর্ধ্বে। মোটকথা অনেক দলীল ও প্রমাণাধীর ভিত্তিতে মুফতিগণ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, তা সুন্নতে মুআক্কাদাহ।
হাল যামানায় কিছু লোক ইসলামের লেভেল গায়ে ঝুলিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরকে এ কথার সবক শেখাচ্ছে যে, তা সাধারণ নফলের মত। না পড়লে কোন গুনাহ নেই।
দোহাই লাগে এসব মিথ্যা আর প্রোপ্রাগান্ডার শিকার হয়ে নিজের আমালকে ধ্বংস করবেন না। রামাযানে আমালের পাল্লা ভারী করতে আসুন নিজে সচেতন হই।
প্রিয় পাঠক বৃন্দ! আমরা সবাই এ কথা জানি যে সালাতুত তারাবি হচ্ছে ২০ রাকাত। শুধু জানাতেই শেষ নয়, বরং আমরা ২০ রাকাত তারাবি আদায়ে খুব অভ্যস্ত বটে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গত দুয়েক বছর ধরে আমাদের শাহজালালের পূণ্যভূমির প্রায় সবকটি পাড়া-মহল্লার মসজিদে ইহুদি নাসারাদের দালাল ‘আহলে হাদিস’ নামধারী হাদিস রিরোধী লা মাযহাবি কুচক্রি মহল তাদের নিজ অর্থায়নে সাধারণ মুসলমানদের ঈমান-আকিদা নষ্ট করার জন্য তারাবি নামায ৮ রাকাত বলে লিফলেট, বই, প্রকাশ করে তা বিনামূল্যে হাতে তুলে দিচ্ছে। আসুন সহীহ হাদিসের আলোকে জেনে নেই সালাতুত্ তারাবিহ রাকাত সংখ্যা কত?
রাকাআতে তারাবি: একটি সন্ধানী পর্যালোচনা: শাসনের নামে শোষক ইংরেজদের পদার্পণ এ যমিনে ঘটার পূর্বে কিছু বলার বা লিখার প্রয়োজন ছিল না। কেননা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত এমনকি গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে প্রতিটি অলিগলির বাসিন্দাদের কাছে মুতাওয়াতির তরিকায় ২০ রাকাত তারাবি আদায়ের কথা পৌঁছেছে। আর আজও আদায় হচ্ছে বিশ্বের সবকটি মসজিদে। সে যুগে কোন কোন মসজিদে বিশরাকাতের অধিক ও পড়া হত; তবে বিশ রাকাতের কম পড়া হত কেউ দেখাতে পারবেনা। মুখস্ত আর শিখিয়ে দেয়া বুলি ছোঁড়ে নিজেকে ‘হাদীস অনুসারী’ দাবী করা নিতান্তই বোকামী ছাড়া আর কিছুই নয়।
ইংরেজদের পায়ে তেল লাগিয়ে নিজ জামাতের নাম ‘আহলে হাদীস’ মঞ্জুর করিয়ে নিয়েছে। মুসলমানদের ঐক্যে ফাঁটল সৃষ্টি করাই হচ্ছে এই দলের মূল লক্ষ্য। তাদেরই একজন তারাবি সংক্রান্ত মাসআলায় লিখেছে বিশরাকাত। (গোলাম রাসূল রচিত ‘রেসালায়ে তারাবি)
ভারতবর্ষের পরে এ নিয়ে কথার্বাতা শুরু হয় আরবজাহানে। আহলে হাদীস তথা লা-মাযহাবিরা শায়খ আলবানিকে গুরু হিসেবে সম্মান করে থাকেন। তার রচিত গ্রন্থকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। সেই আলবানিও আট রাকাতের পক্ষে কোন সাহবী, তাবেঈ, ফক্বীহ বা ইমাম এর নাম উল্লেখ করতে পারেন নি। তবে ইলমের আমানতদারীতে খেয়ানত করে এ ক্ষেত্রে ইমাম মালিক (রাহ.) এর নাম উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি নাকি বিশ রাকাত তারাবি পড়তে বাঁধা দিতেন। ইন্নালিল্লাহ! অথচ ইমাম মালিক (রাহ.) র মাযহাবের মৌলিকগ্রন্থ ‘আল্-মুদাওওনা’ গ্রন্থে স্পষ্ট বর্ণিত আছে তিনি তারাবির নামায বিতর তিন রাকাতসহ মোট ৩৯ রাকাত পড়তেন। মদীনার তখনকার আমির কমাতে চাইলে তিনি নিষেধ করেন। (আল্-মুদাওওয়ানাতুল কুবরা:১/১৯৩)
বর্তমান হিন্দুস্তানের সবচেয়ে বড় মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা হাবিবুর রহমান আজমি (রাহ.) ‘রাকাআতে তারাবি’ নামক একটি গবেষণাধর্মী গ্রন্থে সাহাবী যুগ থেকে শুরু করে লা-মাযহাবী ফিৎনার জন্ম হওয়ার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে ১২০০ শত বছরের ‘আমালে মুতাওয়াররাস’ উম্মতের সম্মিলিত, অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা এক এক শতাব্দি করে দেখিয়েছেন যে, আট রাকাতে সীমাবদ্ধ রাখা এবং বিশ রাকাতের উপর আপত্তি করা কোন পূর্বের শতাব্দিগুলোতে ছিল না। হাদীসবিরোধী আহলে হাদিস তথা লা-মাযহাবিদের আবিস্কার। আল্লামা হাবিবুর রহমান আজমি (রাহ.)’র এই গ্রন্থ ১৩৭৭ হিজরিতে প্রথম প্রকাশিত। এই গ্রন্থে যে দলিল প্রমাণ দেখানো হয়েছে তা খুন করার মত দুঃসাহস হয়নি লা- মাযহাবিদের। অর্ধ শতাব্দি পেরিয়ে গেছে এই গ্রন্থের জবাবে টু শব্দ করেননি তারা।
তারাবির নামায: ২০ রাকাত হওয়ার দলীল
সহিহ হাদিসে রাসূলে কারিম (সা.) নিজ সুন্নতের পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে অনুসরণ করার এবং তা মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন।
ইরশাদ হচ্ছে- ‘‘মনে রেখো! আমার পরে তোমাদের যারা জীবিত থাকবে, তারা বহু মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন আমার সুন্নত ও আমার খলিফাগণের সুন্নতকে আঁকড়ে ধরে রাখবে। একে অবলম্বন করবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখবে …। এবং তোমরা (ধর্মীয় বিষয়ের) আবিস্কৃত বিষয়াবলী থেকে খুব সতর্কতার সাথে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রতিটি নবআবিস্কৃত বিষয় হচ্ছে বেদআত। আর প্রত্যেক বেদআত হচ্ছে গোমরাহী।’’
(সুনানে আবুদাউদ, হাদীস নং ৪৬০৭, জামে তিরমিযী ৫/৪৩হাদিস নং ২৬৭৬; সুনানে ইবনে মাজা হাদিস নং ৪২)
জামে তিরমিযির ২২২৬ নং হাদিসে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র ইন্তেকালের পর খেলাফতের মেয়াদ ত্রিশ বছর হওয়ার ঘোষণা স্বয়ং নবীজি দিয়েছেন। সে হিসেবে খুলাফায়ে রাশেদীন চারজন ১. সিদ্দিকে আকবর (রা.) ২. ফারুকে আযম (রা.) ৩. উসমান (রা.) ৪. আলী (রা.)। খুলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে ওহির মাধ্যমে রাসূল (সা.) এটা জেনেছিলেন যে, তাদের সুন্নতসমূহ নবী-শিক্ষার উপরই ভিত্তিশীল হবে। তাদের সুন্নতসমূহ নববী সুন্নতেরই অনুগামী হবে এবং আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি মোতাবেক হবে এ জন্যই তিনি উম্মতকে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত তথা আমালকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
১ম দলীল : খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত-
হযরত উমর (রা:)’র যুগ
ইয়াযিদ ইবনে খূসায়ফা (রাহ.) বলেন, হযরত সায়েব ইবনে ইয়াযিদ (রা.) বলেছেন-
অর্থাৎ ‘‘তাঁরা (সাহাবা ও তাবেয়িন) উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)’র যুগে রামাযান মাসে বিশ রাকাআত পড়তেন।’’ (আস্-সুনানুল কুবরা, বায়হাকি শরিফ ২/৪৯৬)
হযরত সায়েব ইবনে ইয়াযিদ (রা.)’র বর্ণনা:
‘আমরা হযরত উমর (রা.)’র যামানায় বিশ রাকাআত এবং বিতর পড়তাম।’ (বায়হাকি ১/২৬৭)
এই হাদিসটির সনদ সহিহ। হাদিস ও ফিক্বহ শাস্ত্রের বহু ইমামগণ এটাকে দলিল হিসেবে গ্রহন করেছেন। হাফিযুল হাদিস অনেকেই তা সহিহ হওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। যেমন: ইমাম নববী, তকিউদ্দীন সুব্কি, ওলিউদ্দীন ইরাকি, বদরুদ্দিন আইনি, জালাল উদ্দিন সুয়ূতি রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমূখ।
(নাসবুর রায়াহ ২/১৫৪, উমদাতুল ক্বারি শারহুল বুখারি ৭/১৭৮, আল্-মাসবিহ ফি সালাতিত তারাবি)
উপরোক্ত হাদিসটির বিশুদ্ধতার উপর শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানি এবং আব্দুর রহমান মুবারকপুরীর আগে কোন ইমাম বা মুহাদ্দিসগণ আপত্তি উত্থাপন করেননি। লামাযহাবি আলেমদের আপত্তি কখনোই এই সহিহ রেওয়ায়াতকে অকেজো করতে পারবেনা।
তাবেঈ ইয়াযিদ ইবনে রূমান (রাহ.)’র ভাষ্য:
‘‘হযরত উমর (রা.)’র যুগে মানুষ (সাহাবা ও তাবেঈন) রামাযান মাসে ২৩ রাকাআত পড়তেন।’’ (মুয়াত্তা মালিক: ৪০, বায়হাকী ২/৪৯৬)/তাবেঈ ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আনসারী রাহ. এর বিবরণ:/
‘‘হযরত উমর রা. এক ব্যক্তিকে আদেশ করেন, তিনি যেন লোকদের নিয়ে ২০ রাকাআত পড়েন।” (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২/২৮৫)
এ ধরনের আরো অসংখ্য রেওয়ায়াতের আছে, যার মূল বক্তব্য মুতাওয়াতির। ফলে এ বিষয়টির অকাট্য প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে কোন দ্বিধাদ্বন্দের অবকাশ থাকেনা। এরপরও লা মাযহাবি বন্ধু মহলের অভিযোগ হল এ বর্ণনাগুলো নাকি মুরসাল। আর মুরসাল বর্ণনা দুর্বল হয়ে থাকে। কাজেই এ ক্ষেত্রে আমি শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. এর একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি যাকে লা মাযহাবিরা অনুসরণীয় এবং কাছের মানুষ মনে করে থাকেন।
মুরসাল সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন-
‘‘যে মুরসালের অনুকুলে অন্য কিছু পাওয়া যায় কিংবা পূর্বসূরিগণ যার অনুসরণ করেছেন তা ফকিহগণের সর্বসম্মতিক্রমে দলিল হিসেবে গ্রহণীয়’’ (আল্-ফাতাওয়াতুলকুবরা ৪/১৭৯)
বিশরাকাআত তারাবির ব্যাপারে তিনি বলেন- ‘‘খুলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নত এবং মুসলিম উম্মাহর সম্মিলিত আমল দ্বারা এটি প্রমাণিত’’ (মাজমাউল ফাতাওয়া: ২৩/১১৩)
৩য় খলিফা হযরত ওসমান গণী (রা.)’র যুগ:
হিজরি ১৪ সন থেকে হযরত উমর (রা.) এর শাহাদাত পযন্ত মোট ১০ বছর হযরত ওসমান গণী (রা.) এর উপস্থিতিতেই বিশ রাকাআত তারাবি হয়েছে। তিনি এর উপর কোন আপত্তি উত্থাপন করেননি। এতে বুঝা যায় যে, তিনিও ২০ রাকাআতের পক্ষে ছিলেন।
৪র্থ খলিফা আলি ইবনে আবি তালিব (রা.) এর যুগ:
প্রখ্যাত তাবেঈ ইমাম আবু আব্দুর রহমান আস্সুলামি (রহ.) এর বর্ণনা: ‘‘ আলী (রা:) রামাযানে কারিগণকে ডাকেন এবং তাদের একজনকে আদেশ করেন যে, তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত পড়েন এবং আলী (রা.) তাদের নিয়ে বিতর পড়তেন (বায়হাকি শরিফ: ২/৪৯৬-৯৭)
তাবেঈ আবুল হাসনা (রাহ.) ভাষ্য: ‘‘আলী (রা.) এক ব্যক্তিকে আদেশ করেন তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত তারাবি পড়েন। (মুসন্নাফে ইবনে আবি শাইবা ২/২৮৫)
২য় দলীল ইজমায়ে সাহাবা: সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি। তারা আমাদের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয়। তাদেরকে ফলো করার কথা স্বয়ং নবীজি (সা.) বলেছেন। সর্বক্ষেত্রে তাঁরা আমাদের উৎসাহ আর প্রেরণার বাতিঘর। তারাবির নামায ২০ রাকাআত হওয়ার ব্যাপারে শুধু মুহাজির আনসার নয়, সকল সাহাবির ঐকমত্য রয়েছে। মসজিদে নববিতে ১৪ হিজরি থেকেই উবাই ইবনে কা’ব (রা.) এর ইমামতিতে প্রকাশ্যে বিশ রাকআত তারাবিহ পড়া হত। প্রশ্ন হতে পারে হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. এর ইকতেদা তথা অনুসরণ করতেন কারা? সমস্ত মুহাজির ও আনসার সাহাবিরাই ‘ইকতাদাইতু বিহাজাল ইমাম’ বলে তাঁর পিছনে নামায আদায় করতেন। যাদের মধ্যে বিখ্যাত হাদিস বিশারদ সাহাবি, ক্বারি সাহাবি, ফক্বিহ সাহাবি ও ছিলেন। তাদের কেউই কখনো ২০ রাকাআতের ব্যাপারে কোন আপত্তি করেননি।
প্রখ্যাত তাবেঈ ইমাম আতা আবি রাবাহ মক্কি (রাহ.) বলেন- ‘‘আমি লোদেরকে (সাহাবা ও প্রথম সারির তাবেঈনকে) দেখেছি, তারা বিতরসহ তেইশ রাকাআত পড়তেন।’’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা ২/২৮৫)
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহ.) এর বর্ণনা: ‘‘এটা প্রমাণিত উবাই ইবনে কা’ব (রা.) রামাযানে তারাবিতে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাআত পড়তেন এবং তিন রাকাআত বিতর পড়তেন। তাই অনেক আলেম এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, এটিই সুন্নত। কেননা উবাই ইবনে কা’ব (রা.) মুহাজির ও আনসারি সাহাবীগণের উপস্থিতিতেই বিশ রাকাআত পড়িয়েছেন এবং কোন একজনও তাতে আপত্তি করেননি। (মাজমাউল ফাতাওয়া: ইবনে তাইমিয়া ২৩/১১২-১১৩)
ইমাম আবু বকর কাসানি রাহ. বলেন- ‘‘ অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম যা বলেছেন তাই ঠিক। কেননা হযরত উমর (রা.) রামাযান মাসে সাহাবায়ে কেরামকে উবাই ইবনে কা’ব (রা.) এর ইমামতিতে একত্রিত করেন এবং তিনি তাদেরকে নিয়ে প্রতি রাতে বিশ রাকাআতই পড়তেন। তাদের ইজমা সম্পন্ন হয়েছে। (বাদায়েউস সানায়ে ১/৬৪৪)
মোটকথা তারাবির নামায বিশ রাকাত খুলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নত, মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের ইজমা, অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামের ইজমা এবং সম্মিলিত সকল মুসলিম উম্মাহের ধারাবাহিক কর্মদ্বারায় এ কথা প্রতিয়মান হয় যে, তারাবি ২০ রাকাআতই। এসব দলিল প্রমানাধি থাকা সত্ত্বেও লা মাযহাবিরা ঈসা ইবনে জারিয়ার বর্ণনাকৃত ৮ রাকাআত এর রেওয়ায়াত রেফারেন্স হিসেবে পেশ করেন যে ঈসা ইবনে জারিয়াকে হাদিস শাস্ত্রের ইমামগণ মাতরূক তথা পরিত্যাজ্য সাব্যস্ত করেছেন। ইমাম ইবনে আদি (রাহ.) হাদিসটিকে ‘‘গায়রে মাহফুজ’’ আখ্যা দিয়েছেন।
এ রকম দুয়েকটি দুর্বল ও নড়বড়ে রেওয়ায়াত দিয়ে তথাকথিত আহলে হাদীস নামধারী হাদিস বিরোধীরা চায় যে, মুসলিম জাতির প্রায় পনের শত বছরের ইবাদতি ঐতিহ্যে চুনকালি মাখাতে। তারা চায় যে মুসলিম উম্মাহর ইবাদতে এলাহিয়্যাতে কালিমা লেপন করতে।
প্রিয় পাঠক/পাঠিকা মহোদয়!
উল্লেখিত আলোচনা-পর্যালোচনা দ্বারা এ কথা দিবালোকের মত সুস্পষ্ট হয়েছে যে, তারাবির নামায বিশ রাকাআত তা রাসূলের যুগে এবং সাহাবীদের যামানা থেকে অদ্যাবধি সারাবিশ্বে বিশ রাকাআতই তারাবি হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাআল্লাহ। হাল যামানায় হাতেগুনা কিছু হালুয়া-রুটির ভক্ত-মুরিদরা ইংরেজদের প্রেম সাগরে হাবুডুবু খেয়ে নিজের স্বকীয়তা জলাঞ্জলী দিয়ে তাদের মদদে আমার দেশের সাধারণ সাধারণ মুসলমানদের ঈমান-আক্বিদা ধংসের নীল নকশা আঁকছে। আসুন, আজই আমরা সচেতন হই এবং এদেরকে জানার এবং চেনার চেষ্টা করি। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সবার ঈমান-আক্বিদা ও আ’মালকে হেফাজত করুন আমিন।
লেখক: শিক্ষাবিদ, ইসলামী চিন্তাবিদ