গোয়াইনঘাটে বেপরোয়া বালু ও পাথর চক্র: নেপথ্য আলিম উদ্দিন
- আপডেট টাইম : ০৮:৫৮:৩৯ অপরাহ্ণ, বুধবার, ২৬ জুলাই ২০২৩
- / ১৪৭ ৫০০০.০ বার পাঠক
সিলেটের জাফলং-পিয়াইন পাথর নৈরাজ্যের নৌপথের রাজা আলিম উদ্দিন। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি রাহাজানী ও নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিস্তর অভিযোগ রয়েছে স্হানীয় পাথর শ্রমিক ও এলাকাবাসীর মধ্যে। তার বাড়ি সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট থানার জাফলং এলাকায়। জাফলং ও পিয়াইন নদীতে চলাচলকারী পাথর-বালুবাহী শতশত নৌকা ও বলগেট থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি পাথর ও স্টোনক্রাশার মালিকদের কাছ থেকে বখরা আদায় তার ও তার চক্রের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। জাফলং ও পিয়াইন নদী এলাকার ছোট-বড় সব চাঁদাবাজ চক্রের নিয়ন্ত্রক করে আলিম উদ্দিন চক্র। আলিম উদ্দিন নিজেকে পাথর ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেও মূলত পাথর মহালে চাঁদাবাজিই তার মূল পেশা বলে জানিয়েছে স্হানীয়রা। চাঁদাবাজির মাধ্যমে দৈনিক লাখ লাখ টাকা আদায় করে বর্তমানে শতকোটি অবৈধ টাকার মালিক তিনি। এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরাতো আলিম উদ্দিন পরিবারের।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জাফলং ব্রিজের নিচ দিয়ে উজানের বালু নিয়ে ভাটিতে যাচ্ছে নৌকার বহর। ব্রিজসহ গোটা এলাকাই হচ্ছে পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু আলিম উদ্দিনের বাহিনী এর কোন ধার ধারছেনা এমনকি মানছে না (ইসিএ) নির্দেশনা। তার ক্ষমতাবলে জাফলংয়ের ইসিএ জোন পরিনত হয়ে উঠেছে বালু লুটের মহোৎসবে। স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন গোয়াইনঘাট উপজেলার সবকয়টি নদীতে বোমা মেশিন দিয়ে লাখ টাকার বালু লুটপাট করা হচ্ছে আলিম উদ্দিনের ইশারায়। আলিম উদ্দিনসহ তার চক্রের সদস্যরা নিজেদের স্থানীয় সংসদ সদস্য ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদের নিজের লোক বলে প্রচার করছে। এতে তাদের দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে প্রশাসনও। প্রায় এক মাস ধরে জাফলং চা বাগান ও কান্দুবস্তি এলাকাসহ পিয়াইন নদী অবৈধভাবে নির্বিচারে লুট করা হচ্ছে বালু। বর্তমানে আগের তুলনায় বেড়েছে লুটপাট। বালু মহালের অবস্থান হচ্ছে লুটপাটকৃত এলাকা থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে। অথচ সারি-২ বালু মহালের নামে গোটা জাফলংকে গিলে খাচ্ছে বালু ও পাথর খেকো আলিম উদ্দিন। তার ইশারায় নির্বিচারে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকির মুখে পড়েছে শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত জাফলং ব্রিজ। এছাড়া নয়াবস্তি ও কান্দু বস্তি নামের দুটি গ্রাম ও জাফলং চা বাগানও রয়েছে হুমকির মুখে।
স্থানীয়রা আরো জানান, জাফলংয়ের বালু ও পাথর সিন্ডিকেটের সদস্যরা এবার ঐক্যবদ্ধ হয়েই বালু লুটপাটে নামে। প্রায় এক মাস আগে থেকেই তারা নদীতে অবস্থান নেয়। এরপর ব্রিজের উভয়পাশ থেকে তারা বালু উত্তোলন শুরু করে। এই দুই মাসে তারা কয়েক কোটি টাকার বালু লুট করে। জাফলং ব্রিজের উজানে নয়াবস্তি ও কান্দুবস্তি এলাকায় বালু লুটপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছে জাফলংয়ের এক সময়ের লুটপাটকারী আলিম উদ্দিন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতার শেল্টারে তারা প্রতিদিন নদীর উজান এলাকা থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকার বালু লুট করছে। প্রতি বালুর ফুট হিসেবে তাদেরকে ২ টাকা হারে চাঁদা দিতে হচ্ছে। ২ হাজার থেকে ৬ হাজার ফুট ধারণ ক্ষমতার নৌকা ভর্তি করে বিক্রি করা হয় এসব বালু। কান্দু বস্তির এক বাসিন্দা অভিযোগ করেছেন- কার্গো কিংবা নৌকাতে বালু ভর্তি করতে ড্রেজারের প্রয়োজন হয়। প্রতিদিন প্রায় ৫০০ বড় নৌকা তাদের এলাকায় লোড দেয়া হয়। আর এ লোডে ব্যবহার করা হয় ড্রেজার মেশিন। প্রায় ৪-৫শ’ ড্রেজার মেশিনের শব্দে এলাকার পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। দিনের চেয়ে রাতে বেশি সংখ্যক ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। বালুখেকোদের দাপটের কারণে ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না জাফলং বাগানের খাসিয়ারা ও কান্দুবস্তির বাসিন্দারা।
অন্যদিকে, জাফলং ব্রিজের নিচে মন্ত্রীর নামে অবস্থান নিয়েছেন আলিম উদ্দিন চক্রের সদস্যরা। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার কারণে কয়েক কিলোমিটার দূরের আরেক উপজেলার বিভিন্ন নদীতে ‘টোকেন’ দিয়ে তারা বালু উত্তোলন করছে। আলিম উদ্দিনের নেতৃত্বে প্রতিদিন প্রায় ১৫-২০ লাখ টাকার বালু লুটপাট করা হয়। তাদের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা সম্পৃক্ত রয়েছে। তাদের ভাগের টাকা যায় প্রশাসনসহ সব মহলে। বৈধ বালু মহালের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন- বালু প্রবাহ হচ্ছে উজান থেকে। উজানে মন্ত্রীর লোক পরিচয় দিয়ে অবৈধভাবে প্রতিদিনই ৩০-৩৫ লাখ টাকার বালু লুট করা হয়। তাই আমরা বালু সংগ্রহ করতে পারছিনা। ফলে সরকারকে টাকা দিয়ে বালু মহাল লিজ আনলেও আমরা পড়েছি লোকসানের মুখে।
জাফলংয়ের পরিস্থিতি নিয়ে হতাশার বানী শুনালেন সিলেটের পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ইমরান হোসেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, ‘অবাধে লুটপাট হচ্ছে বালু ও পাথর; আমরা গিয়ে জরিমানা করেছি। কিন্তু আমাদের এই সামান্য শাস্তি তাদের অবাদে বালু উত্তোলন থেকে বিরত রাখতে পারছেনা। এ বিষয়ে লুটপাট সিন্ডিকেটকে ‘কঠিন’ সিন্ডিকেট বলেও অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘ওরা এতোটাই বেপরোয়া, অভিযান কিংবা জরিমানা যেন তাদের গায়েই লাগে না। অভিযানে গেলে তারা দৌড়ে পালিয়ে যায়। পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা থেকেই তারা বালু লুট করছে।’