তুচ্ছ ঘটনায় শাকিল হত্যা: এখনো অপেক্ষায় সন্তানেরা বিচারের দাবি
- আপডেট টাইম : ০৭:৪২:১৮ পূর্বাহ্ণ, মঙ্গলবার, ৮ নভেম্বর ২০২২
- / ১৮৫ ৫০০০.০ বার পাঠক
ঠাকুরগাঁওয়ে তুচ্ছ ঘটনায় মৎস্যজীবীলীগের নেতাকে পিটিয়ে হত্যার পর এখনো বাবার অপেক্ষায় সন্তানেরা। দিন কাটছে অশ্রু চোঁখে। পরিবারের দাবি হত্যার ঘটনায় জড়িত মামলার ১ নং আসামী ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামসহ সবার দৃস্টান্তমুলক শাস্তির।
সাড়ে তিন বছরের শিশু পাপড়ী আহমেদ। বাবাকে হারিয়েছে প্রায় দুই মাস আগে। বাবার আদরের শূন্যতা সে এখনো বুঝতে শিখেনি। এভাবেই ছবি নিয়ে বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকেন পাপড়ী। পাশে বসা ভাই মাসুম আহমেদ (৮)। নিহত বাবার কথা বলতেই ছলছল করে ওঠে অবুঝ শিশুর মায়াবি দুই চোখ। গাল বেয়ে ঝরে ফোঁটা ফোঁটা নোনা জল। শিশু দু’টির এই বোবা কান্নায় স্পষ্ট ফুটে ওঠে পিতৃহীন সন্তানের অব্যক্ত গল্প। তাদের কান্না দেখে মা কাকুলী আক্তারের চোঁখও যেন ছলছল করছে। চোখের পানি মুছে চাপা কষ্ট লুকানোর চেষ্টা করে তিনি।
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি তারা। এটি ঠাকুরগাঁওয়ের নিহত শাকিল আহমেদের পরিবারে বাস্তবতা। শাকিল আহমেদ বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভানোর ইউনিয়নের হলদিবাড়ী গ্রামের মৃত সামশুল আলমের ছেলে।
শাকিল হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা তুলে ধরেছেন তার বড় ভাই ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাঈদ আলম। তিনি জানান, গত শুক্রবার (০২ সেপ্টেম্বর) বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ভানোর ইউনিয়নের হলদিবাড়ী জামে মসজিদে খুতবা দেওয়ার সময় হযরত মুহাম্মদ (সা)’কে মুচি ও দর্জি বলে মন্তব্য করেন ইমাম। মহানবীকে অসম্মান করে কথা বলায় আমি ও মুসল্লিরা প্রতিবাদ জানায়। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মাঝে উত্তেজনা দেখা দিলে এক পর্যায়ে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হয়। ওই দিন রাতেই চারজনকে আসামী করে আমি বালিয়াডাঙ্গী থানায় একটি অভিযোগ দেয়।
সংঘর্ষের খবর পেয়ে ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম ও তার লোকজন ক্ষিপ্ত হয়ে পরের দিন (শনিবার ০৩সেপ্টেম্বর) আমাকে আটকিয়ে মারধর করেন। আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন ছোট ভাই ইউনিয়ন মৎস্যজীবী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাকিল আহম্মেদ ও পরিবারের লোকজন। এসময় চেয়ারম্যান ও তার লোকজন আমাদের দুই ভাইকে লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি মারধর করেন। পরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে আর আহতদের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। শাকিলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে কর্তব্য চিকিৎসক তাকে দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরের দিন রবিবার ভোর সাড়ে ৫টায় শাকিল মারা যান। ওই দিনেই ইউপি চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামকে প্রধান আসামী করে ২০ জনের বিরুদ্ধে বালিয়াডাঙ্গী থানায় একটি হত্যা মামলা করি। র্যাব ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে চেয়ারম্যান সহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেন। তবে মামলা করায় চেয়ারম্যানের লোকজন ও অন্যান্য আসামীরা আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে। আমার বাড়িতে রাতে আধারে ইট পাটকেল দিয়ে হামলা চালায়। আমি ও আমার পরিবারের সকলেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।
তিন বছরের মেয়ে পাপড়ি ও আট বছরের ছেলে মাসুমকে নিয়ে কাঁদছিলেন সাকিলের স্ত্রী কাকুলী আক্তার। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘স্বামীকে হারিয়েছি। দুটি ছোট ছোট সন্তান নিয়ে এখন কোথায় দাঁড়াব! কী করব! যে সংসার চালাত সে আর নেই। কীভাবে কী করব কিছু মাথায় আসছে না। আমার স্বামীকে রফিকুল চেয়ারম্যান সহ তার লোকজন পিটিয়ে মেরে ফেললো। যা হারানোর সেটা আমরা হারিয়েছি। আমার দুটা সন্তান। ১০ বছরের সংসারের সব শেষ হয়ে গেল। মেয়েটা বাবার জন্য রাত-দিন কান্না করছে। তারা অনেক প্রভাবশালী প্রতিনিয়তই আমাদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। হয়তো টাকার ক্ষমতায় তারা আইনের জালে বেশিদিন থাকতে পারবে না। আল্লাহ তাদের বিচার করবে।
শিশু পাপড়ী বলেন, অনেক দিন থেকে বাবাকে দেখি না। রাতে বাবার জন্য গেটে দাঁড়িয়ে থাকি। পাশের বাড়ির দাদি বলছে মানুষেরা নাকি আমার বাবাকে মেরে ফেলছে। বাবা নাকি আর বাড়িতে আসবে না। সবাই বাবার ছবি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে কেন? বাবা আমাকে বলেছে আমার জন্য পুতুল নিয়ে আসবে।
ওদিকে পুত্র শোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন মা শাহিনুর বেগম (৫০)। স্বামীর পর ছোট ছেলেকে হারিয়ে ছেলের বউ ও অবুঝ দুই নাতি-নাতনীকে নিয়ে অথৈ সাগরে ভাসছেন তিনি। দুই শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভুগছেন অনিশ্চয়তায়। তিনি বলেন, আমার নির্দোষ ছেলেটাকে রফিকুল ও তার লোকেরা পিটিয়ে হত্যা করেছে। যারা আমার বুক খালী করেছে তাদের আমি বিচার চাই। এ ঘটনায় চেয়ারম্যানসহ যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের জামিন হলে এলাকায় আরো সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাবে। তাদের উচিত বিচার না হওয়া পর্যন্ত জেলে রাখার অনুরোধ পরিবারের। শাকিলের পরিবারের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য আসামীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান ঠাকুরগাঁও পুলিশ সুপার (এসপি) মো: জাহাঙ্গীর হোসেন।