বিদ্বেষের প্রতিক্রিয়ায় ভাষার আবেগ
- আপডেট টাইম : ০৩:১৫:১৭ অপরাহ্ণ, রবিবার, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২
- / ২৬০ ৫০০০.০ বার পাঠক
সময়ের কন্ঠ রিপোর্ট।।
ভাষা কোনো ভিনগ্রহ থেকে ছিটকে পড়া বস্তু নয়। আমজনতার রুটি-রুজি বা শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অধিকার-সবের সঙ্গেই তা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে। রক্ত-মজ্জা-জিনে প্রথিত হয়ে আছে আমাদের ভাষাবোধ; যা পরস্পর ভাব প্রকাশের সেতুবন্ধ। নিজেদের মধ্যে ভাবনা বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবেই ভাষার আত্মপ্রকাশ; হয়তো অনেকটা বাধ্য হয়েই। বুদ্ধির তাড়নায়। আর এ প্রবৃত্তিই অন্যান্য জীব থেকে আলাদা করেছে মানুষকে। শব্দ হলো সংকেত। শব্দ থেকে জ্ঞানের উত্তরণ, চেতনার উন্মেষ। কালের গতি বদলে দিয়েছে ভাষা। ইতিহাস বলে, রূপান্তরের পথেই সৃষ্টি হয়েছে বাংলালিপি। সেভাবেই বাংলা বর্ণমালা; যা অনেক ভাষার নেই। এমন একটা সাংস্কৃতিক বৃত্ত তৈরি করেছে এ ভাষা, যার গর্ভে অবলীলায় সৃষ্টি হয় নতুন জাতি, নতুন গোষ্ঠী। যেখানে ভাবনায়, কল্পনায় সবাই একাত্ম। ভাষা না বাঁচলে আঞ্চলিক সংহতি মজবুত হয় না, স্বাতন্ত্র্য টেকে না। রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও অখণ্ডতার জন্যও চাই ভাষার অধিকার। আর এ অঞ্চলে সংস্কৃতির সঙ্গে ভাষার যোগ অনেক গভীর। ভাষা আন্দোলন আমাদের গৌরবের এক আখ্যান, ইতিহাসের মহত্তর পর্ব-তার পথ বেয়েই পৃথিবীর কোল আলো করে জন্ম নিয়েছে নতুন এক দেশ; যার তুলনা মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল।
রাজনীতি, অর্থনীতি কিংবা সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষাও কখনো কখনো ভাষার প্রসার ও বিস্তারে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। ইংরেজি নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহ্যবাহী ভাষা; যার প্রভাব সত্যি বলতে কী আমাদের ডিএনএতে। আমরা একে ‘কলোনিয়াল হ্যাংওভার’ বলে কটাক্ষ করি, কিন্তু তাকে উপেক্ষা করতে পারি না। এ ভাষার আধুনিক রূপের দেখা মেলে ১৫ শতকেই। অনেক আঞ্চলিক ও দেশজ ভাষার সংমিশ্রণ এ ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। চীনা ভাষাও বিশ্বের ভাষিক মানচিত্রে আধিপত্য বজায় রেখে চলেছে। ফরাসি, স্প্যানিশ, জার্মান ভাষার দাপটও অস্বীকার করার নয়। পর্তুগিজ, রোমান, গ্রিক, আরবি, হিব্রু ভাষায়ও অনেক মানুষ কথা বলে। আফ্রিকা অনেক ভাষার উর্বর জন্মভূমি। মজার ব্যাপার হলো-এ মহাদেশের একটি দেশ সিয়েরেলিওন। বাংলা এখানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। সুনীতি চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন, কীভাবে বাংলার অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়ভাষী জনগোষ্ঠী মগধের প্রাকৃত ভাষা গ্রহণ করেছে।
মূলত ইন্দো-আর্যভাষা, সংস্কৃত-পালি ও প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। চর্যাপদ, চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন ও আধুনিক বাংলা-আমাদের ভাষার ইতিহাস এ তিন পর্বেই বিভক্ত। যাই বলি না কেন, আমরা যারা বাংলা ভাষা ব্যবহার করি, নানা শিল্পমনের বিচিত্র ব্যঞ্জনা নানাভাবে প্রতিফলিত হয়। আর যে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, তা হলো-ভাব প্রকাশের মধ্য দিয়ে মাতৃভাষার জন্য এক রকমের আবেগ, ভালো লাগা ও অনুভবের জায়গা তৈরি হয় বাঙালি মননে। আমাদের ভাষার নিজস্ব যে একটা বুদ্ধিপ্রদ আভিজাত্য রয়েছে-তা বারেবারে প্রতিভাত হয়।
ইতিহাস অনুসন্ধানে ধরা পড়ে, দেশভাগের আগে লাখ লাখ বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান কায়েমের আবেগে ভেসেছে। আরবি, ফারসি শব্দগুলো বাংলা শব্দগুলোকে ত্বরিতগতিতে ক্রমাগত ছিটকে ফেলছিল। সাতচল্লিশপূর্ব প্রায় দশকজুড়ে চলে এমন কাণ্ড। দলে দলে মানুষ পাকিস্তান আন্দোলনে শামিল হয়েছে। আত্মপরিচয়ের সত্তায় বাঙালিত্বের পরিসর ছোট হতে শুরু করেছে। বাঙালি মননে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপনও হয়তো তখনই সম্পন্ন হয়েছে। সরল ও সাধারণ জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা আর স্বপ্ন এ আরোপিত আবেগের নিচে নিভৃতেই চাপা পড়েছে। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার শাসকের যে মনস্তাত্ত্বিক ভিত্তি, তা হয়তো তখনই তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর এ জনপদের এ মানসিক গড়নের প্রকরণ দ্রুত পালটে যায়।
পাকিস্তানে বাংলাভাষী ছিল যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ, উর্দুভাষী একদমই নগণ্য। জিন্নাহ সাহেব তবুও বললেন-উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহ নিজেই ভালোভাবে উর্দু জানতেন না। বলতেনও না। তবে ভালো ইংরেজি জানতেন। শাসকের কৌশল ছিল-ক্ষমতার দখলে থাকবে উর্দু ও ইংরেজি। ভাষায় একচেটিয়া দখলদারির লক্ষ্য হলো-সামাজিক কর্তৃত্বে ক্রমেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা। হিন্দু সামন্তশ্রেণির হাত থেকে মুক্তির আশাই বাঙালি মুসলমানকে পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কা ক্রমেই ঘনীভূত হতে লাগল। কোনো জাতি না খেয়েও উঠে দাঁড়াতে পারে, যদি তার সংস্কৃতি আক্রান্ত হয়। আর ভাষাই যে সংস্কৃতির প্রাণ-এ উপলব্ধি বাঙালি চেতনায় প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠতে থাকে।
ভাষার জন্য যে লড়াই, তা নিছক কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল না, ছিল পূর্ব পশ্চিমের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য ও বিদ্বেষের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। বাংলার ছাত্রজনতা, লেখক, বুদ্ধিজীবী দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রান্তি উপলব্ধি করেন ও তা সপাটে প্রত্যাখ্যান করেন। এ আন্দোলন পাক উপনিবেশবাদের আর্থসামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভের এক পুঞ্জীভূত বিস্ফোরণ। তবে এর মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণি অবিশ্বাস্যভাবে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের সম্পৃক্ততায় আন্দোলন গণচরিত্র লাভ করে। ’৪৭-উত্তর দেশভাগের পর একদিকে যেমন পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের নগ্নচিত্র ভেসে উঠেছিল, ঠিক অন্যদিকেই জেগে উঠেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের অনির্বাণ দীপশিখা; যার বীজ অনেকের মতে, বাঙালি মননে প্রথিত হয়েছিল বহু আগেই।
১৯৩০-৪৭ পর্যন্ত দেশভাগপূর্ব সাম্প্রদায়িকীকরণের সমকালীন স্রোত উপেক্ষিত হয়। বাঙালি চরিত্রে আবহমান বহুত্ববাদী সংস্কৃতির উত্তরাধিকার প্রলম্বিত হয়। পাশ্চাত্যের ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব, রুশবিপ্লব বা ফরাসিবিপ্লবের মতোই আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও এগিয়ে এসেছিল বাঙালির স্বাধিকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে। সূচনা হয়েছিল একটি শোষণমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের স্বপ্নে রাষ্ট্রকাঠামো বদলে ফেলার লড়াই। রক্তাক্ত ভাষাযুদ্ধের ফল ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ, যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। এর ফলে একটি নতুন জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
কয়েকটি আলোচনা থেকে বোঝা যাবে-বাঙালি বিদ্বেষ কতটা গভীর আর ষড়যন্ত্রের জাল কতটা বিস্তৃত ছিল। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের পাঠ্যসূচি থেকে বাংলাকে রীতিমতো ছেঁটে ফেলে হয়। অথচ উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, জার্মান, এমনকি ল্যাটিন ও সংস্কৃতের মতো মৃত ভাষাও সেখানে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় কোর্স পড়ার সুযোগও ছিল। কিন্তু ১৯৫১ সালে সিলেবাস থেকে বাংলা কোর্স বাদ দেওয়া হয়। বাঙালি ছাত্ররা শত চেষ্টা করেও বিএ পরীক্ষায় বাংলা বিষয় নিতে পারেনি। অথচ বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে সিলেবাসে ফ্রান্স, স্প্যানীয় ও জার্মান ভাষাশিক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়। এখানে খেয়াল রাখতে হবে, বাঙালি ছাত্ররা এককভাবে বাংলা চায়নি, উর্দুর পাশে বাংলাকে চেয়েছিল। ছাত্রদের কণ্ঠে যে স্লোগান মুখরিত হয়েছিল, তাও ছিল অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো তার পিতার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন-তিনিও নাকি পশ্চিমাদের এমন বিদ্বেষপূর্ণ শিক্ষানীতির বিরোধী ছিলেন। তারও নাকি যুক্তি ছিল শিক্ষাব্যবস্থায় এমন বৈষম্য থাকলে বাঙালি ছেলেমেয়েরা চাকরি-বাকরিতে পিছিয়ে পড়বে। বেনজির ভুট্টোর এ দাবিও ধোপে টেকে না। কারণ ভুট্টো ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ-ইতিহাসের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কেই গোলযোগ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পূর্ববাংলায় অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা ফাতিমা জিন্নাহও একই সুরে কথা বলেছিলেন। পূর্ববঙ্গের ছাত্র, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা আশঙ্কা করেছিলেন, বৈষম্যমূলক পদক্ষেপগুলো বাঙালিদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ইংরেজি শিক্ষায় ইতোমধ্যেই পিছিয়ে পড়া মুসলমান বাঙালি সবক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়বে। উর্দুর এ আধিপত্য বাঙালিদের আরও পেছনের সারিতে ঠেলে দেবে।
একদিকে ভাষা ও আত্মপরিচয়ের আবেগ, অন্যদিকে আর্থিক বঞ্চনার ঝুঁকি। ডাকটিকিট, রেলটিকিট, মুদ্রা, পোস্টকার্ডে বাংলা নিষিদ্ধ করার পর এমন বাঙালিবিদ্বেষ এ ভাষাগোষ্ঠীকে আতঙ্কিত করে তোলে। পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. তারেক রহমান মনে করেন, ব্যক্তির ভাষা কেড়ে নেওয়া মানেই হলো সংস্কৃতি ছিনিয়ে নেওয়া। অধিকার আদায়ের জন্য মানুষ প্রতিবাদ করবেই। বাংলাদেশেও এভাবেই নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদ উদ্ভূত হয়েছিল। আর তার পথ ধরেই এসেছিল স্বাধীনতা।
বেশকিছু পাকিস্তানি লেখক ও গবেষকরা দেখিয়েছেন-বাঙালিদের কীভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। সাধারণভাবেই বলা হতো, এদের গায়ের রং কালো, এরা খর্বাকায়। মূলত এরা জেলে-চাষি। এরা বাংলায় কথা বলে। এদের জাতিগত শুদ্ধির প্রয়োজন। তাই ভাষার সংস্কারেও এরা হাত দিয়েছিলেন। শুধু আরবি হরফে বাংলা নয়, বাংলা কবিতার উদ্ভট প্যারোডি রচনা করেও তাদের ভাষায় তথাকথিত নীচু শ্রেণির মানুষদের শুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল। শুধু পাকিস্তানিরা নয়, ইংরেজদের একটি অংশও বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণির মুসলমান বলে কটাক্ষ করেছিলেন। হান্টার কমিশনে উত্থাপিত মতামতেও এমন ইঙ্গিত মেলে। ব্রিটিশ সরকার ১৯৪০ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ড. শহীদুল্লাহ মাতৃভাষা হিসাবে বাঙালি মুসলমানকে বাংলাকে গভীরভাবে ধারণ করার পক্ষে অভিমত দেন। সমকালীন শীর্ষ বুদ্ধিজীবীরাও এ বৈষম্যের বিরুদ্ধে নিন্দায় সোচ্চার হন।
দেশ আজ স্বাধীন। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। গোটা বিশ্বের নজরে বায়ান্নর আত্মত্যাগ। পৃথিবীর সব ভাষাগোষ্ঠীর জন্যই এ দিনটি মহিমান্বিত। আমাদের চোখের জলে, চেতনার স্রোতে, শরীরের মজ্জায় আজ ফেব্রুয়ারি। এ ভাষার প্রতি আমাদের শুধু সম্ভ্রম নয়, দায়বদ্ধতাও আছে। একুশের শিশিরভেজা প্রভাতফেরিতে আজও শহিদ স্মরণে কণ্ঠের দখল নেয় আবেগ। কিন্তু ভাষার জন্য সেই ব্যাকুলতা কি আমাদের অন্তরে আজও জেগে আছে-এ প্রশ্ন আমাদের নিয়ত বিদ্ধ করে। সর্বস্তরে বাংলা এখনো চালু হয়নি। ‘বাংলাটা আমার ঠিকমতো আসে না’-গোছের আত্মঘাতী বাঙালিরা আজও চারপাশে। প্রত্যাশা থাকবে ভাষা দিবসের মানবিক চেতনা যেন রাজনীতির চোরাগলিতে হারিয়ে না যায়। কেবলই জনস্মৃতি আর আনুষ্ঠানিকতায় যেন রফিক, শফিক, বরকতরা ভেসে না থাকেন। মাতৃভাষার যথাযোগ্য মর্যাদায় একুশ যেন বেঁচে থাকে কালের সীমান্ত পেরিয়ে।
অমিত রায় চৌধুরী : সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ