ঢাকা ০৬:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

নকল ওষুধে সয়লাব ॥ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি

সময়ের কন্ঠ ডেস্ক :
  • আপডেট টাইম : ০৬:৪৬:০২ অপরাহ্ণ, শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / ২৬২ ৫০০০.০ বার পাঠক

নকল ওষুধে সয়লাব ॥ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি
একাধিক চক্র জড়িত
নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিও
১৯ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল
সময়ের কন্ঠ রিপোর্ট ॥
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেশী-বিদেশী বহু কোম্পানির ওষুধ নকল করছে একাধিক চক্র। ক্যান্সার, হাঁপানি, হার্টের মতো নানা জটিল রোগের ওষুধ নকল করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাজারজাত করে আসছে তারা। এর সঙ্গে কিছু অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী, কেমিক্যাল ব্যবসায়ী, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্টাফ, কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার লোক জড়িত রয়েছে। শুধু তাই নয়; ওষুধ উৎপাদনকারী দেশী প্রতিষ্ঠানও ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন করছে। আর তা দেদারছে বিক্রি হচ্ছে ফার্মেসিগুলোতে। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনের দায়ে ১৯টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইন্সেস বাতিল ও ৪৭টির সাময়িক বাতিল করেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর

দেশী-বিদেশী ওষুধ হুবহু নকল করে বাজারজাতকারী চক্রের একাধিক সদস্যকে সম্প্রতি আইনের আওতায় এনেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জব্দ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকার নকল ও নিম্নমানের ওষুধ, কারখানা ও সরঞ্জামাদি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকল ওষুধ বিপণন নেটওয়ার্কে রয়েছে ওষুধ ব্যবসায়ীরা। নেটওয়ার্কের কেন্দ্র মিটফোর্ড পাইকারি বাজার।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‌্যাব সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে যেসব নকল ওষুধ জব্দ করেছে সেগুলোর উপাদানে মূলত প্রয়োজনীয় জিনিসই নেই। তাছাড়া মেইজ স্টার্চ অত্যন্ত নি¤œ গ্রেডের ব্যবহৃত হয়। এমনকি স্টেরয়েড ও ডাই ব্যবহৃত হতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, নন ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রেডের এসব কেমিক্যাল সেবনের ফলে মানুষের কিডনি, লিভার, হৃদযন্ত্র এবং শ্বাসতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এমনকি জীবনণাশের হুমকিও রয়েছে।
বহুল আলোচিত কোম্পানির ওষুধ নকল ও বাজারজাত করার অপরাধে গত মাসের ১২ ও ১৩ তারিখে সাভার ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ থেকে আটজন এবং চলতি মাসের ২ তারিখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সাতজনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা বিভাগ। ২ তারিখে গ্রেফতার তরিকুল ইসলাম, সৈয়দ আল মামুন, সাইদুল ইসলাম, মনোয়ার, আবদুল লতিফ, নাজমুল ঢালী ও সাগর আহমেদ মিলনসহ প্রত্যেককে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে টিটিপাড়া, ডেমরাসহ বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল ওষুধ তৈরির কারখানা ও বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাদি উদ্ধার করা হয়। চক্র দুটি ইউনানি লাইন্সেস নিয়ে ফার্মাসিউটিক্যালসের মন্টিলুকাস্ট, ওমিপ্রাজল ও সেফিক্সিম গ্রুপের ওষুধ নকল করে দীর্ঘদিন ধরে বাজারজাত করে আসছিল। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধ, ওষুধ তৈরির মেশিন ও ডাইস জব্দ করা হয়।

সাভার ও নেছারাবাদ কারখানায় ভেজাল ওষুধ তৈরির কেমিস্ট হিসেবে কাজ করত আতিয়ার নামে একজন। আতিয়ার মূলত একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ করত। পরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চক্রের কেমিস্ট হয়ে কাজ করে আসছিল। চক্রের অন্যরা প্যাকেজিং, কেমিক্যাল জোগানের কাজ করত। পরে ভেজাল ওষুধ তৈরি করে মিটফোর্ড এলাকার কতিপয় অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মিটফোর্ড ডিপোতে এনে রাখত। গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত ১৫ জনের মধ্যে বেশি সংখ্যক মিটফোর্ড এলাকার। মিটফোর্ড কেন্দ্রিকই চক্রের চারটি গ্রুপ রয়েছে। সেখানকার ওষুধ ব্যবসায়ীর পাশাপাশি কিছু সংখ্যক লেবারও জড়িত। মিটফোর্ড থেকে চক্রটি অর্ডার অনুযায়ী এস.এ পরিবহন, সুন্দরবন ও ইউএসবি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় (বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং ঢাকা, বরিশাল ও রংপুরে বেশি) সরবরাহ করত। এসব কুরিয়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকজন স্টাফ নকল ওষুধ বাজারজাতকরণে সহায়তা করে আসছিল।
ডিবির লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মোঃ সাইফুর রহমান আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, চক্র দুটির বিভিন্ন সেক্টরে লোক রয়েছে। পরস্পরের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে তারা ওষুধ নকল করে আসছিল। এক চক্রেরই ২২ জনের নাম পাওয়া গেছে। পুরো চক্রটিকে আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে।
নকল হচ্ছে বিদেশী ওষুধ ॥ শুধু দেশীয় ওষুধ নয়; বিদেশী ওষুধও দেশে নকল করছে একাধিক চক্র। আগে বিদেশী ওষুধের প্যাকেট তৈরি করে পরে বিদেশী ওষুধের স্যাম্পল সংগ্রহ করে হুবহু নকল করা হচ্ছে। বিদেশী ওষুধ নকল ও বাজারজাত করার সঙ্গে জড়িত কয়েকটি চক্রকে আটকের পর এমনটি জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

২৯ জুন হাতিরপুল, রামপুরা ও মালিবাগ থেকে আমেরিকা-চায়না ব্রান্ডের নামে নকল ওষুধসহ লুবনা আক্তার, আনোয়ার কাজী, রামচন্দ্র বসাক, এসএম তাজমুল তারিক ও কনক কুমার সাহা নামের পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ডিবি গুলশান বিভাগ। এরা অনুমোদন ছাড়া নারায়ণগঞ্জ জালকুড়িতে অবস্থিত কারখানায় বিদেশী ওষুধ নকল করত। অনুমোদনবিহীন বিভিন্ন ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল কেজি দরে অথবা হাজার পিস ধরে কিনে নিয়ে যে যার ইচ্ছামত জেনেরিক নেম অথবা ট্রেড নেম দিয়ে কখনও হার্টের ওষুধ, কখনও লিভারের ওষুধ, কখনও হাড়ের ওষুধ এবং বেশিরভাগ সময় সেক্সের ওষুধ হিসেবে আমেরিকা অথবা চায়না থেকে ইমপোর্ট করা হয়েছে বলে চালিয়ে দিত। চক্রটি চকবাজার, মিটফোর্ড এলাকা থেকে বস্তা ভরা প্লাস্টিকের সাদা লাল সবুজ রঙের বোতল, সিপি, সিলিকন সংগ্রহ করত। কম্পিউটারের দোকান থেকে ইংরেজীতে এ্যাম্বুস করে লেখা বিভিন্ন হলোগ্রাম, মনোগ্রামসম্বলিত ঝকঝকে রঙিন স্টিকার ও লেবেল তৈরি করে লেবেলে এ্যালেক্স ইন্টারন্যাশনাল, রেমেডি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, অর্গানন হেলথ কেয়ার, সান করপোরেশনের মতো বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানির নামে ইমপোর্ট এবং মার্কেটিং করা হয় মর্মে লেখা থাকত। যার কোন অস্তিত্ব¡ই নেই।
সম্প্রতি বংশাল থেকে পাঁচ লাখ টাকা মূল্যের ছয় হাজার ৪৬৪ পিস বিক্রয় নিষিদ্ধ ভারতের ওষুধসহ বাপ্পী চন্দ্র নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১০। গ্রেফতার বাপ্পীসহ চক্রের আরও তিনজনে (পলাতক) মিলে ক্যান্সার, হার্টের বিদেশী ওষুধ নকল করত। এরা লাগেজে করে সীমান্তে পথে ভারতীয় ওষুধ দেশে এনেছে। তবে আগ থেকেই চক্রটি ভারতের ওইসব ওষুধের প্যাকেট বানিয়ে রাখত বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-১০ এর কোম্পানি কমান্ডার (সিপিসি-৩) মেজর আনিসুজ্জামান।
নকল ওষুধ বিপণন নেটওয়ার্কে মিটফোর্ড কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময় নকল ওষুধ তৈরি, বাজারজাত করার সঙ্গে যাদের গ্রেফতার করেছে তাদের বেশির ভাগই মিটফোর্ড কেন্দ্রিক চক্র। মূলত মিটফোর্ড কেন্দ্রিক কতিপয় অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীর সমন্বয়ে নকল ওষুধ উৎপাদন, কেমিক্যাল সরবরাহ ও বাজারজাত করে আসছিল তারা। মিটফোর্ড থেকে সারাদেশের ওষুধ ব্যবসায়ীরা পাইকারি দরে ওষুধ ক্রয় করে থাকেন। এই সুযোগে মিটফোর্ডের পাইকারি বাজারকে বেছে নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠনের ছত্রছায়ায় এমন অপকর্ম করে আসছে কিছু ব্যবসায়ী। সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের কেউ কেউ জড়িত রয়েছে বলেও বিভিন্ন সময়ে নাম এসেছে। ওই এলাকায় মোবাইল কোর্টে পরিচালনা করতে গিয়ে অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীদের বাধার সম্মুখীন হওয়ার ঘটনাও অতীতে ঘটেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিস্ট এ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সহসভাপতি কাজী কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের সংগঠন ওষুধ নকলের ঘোরবিরোধী। আমরাও চাই, নকল ওষুধ উঠে যাক। তবে যারা এসব করছে তারা আমাদের ব্যবসায়ী ঠিক আছে। তারা সামনে একটা বলে, পেছনে আরেকটা করে। অভিযান চালালে কয়দিন বন্ধ থাকে, আবার যেই সেই অবস্থা।
সীমান্তে সক্রিয় ‘লাগেজ পার্টি’ ॥ বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তের একাধিক পথ দিয়ে আনা হচ্ছে বিদেশী ওষুধ। বিশেষ করে ভারতীয় ওষুধ। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আনা এসব ওষুধ বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। যারা সীমান্ত পথে ওষুধ আনছে তাদের বলা হয় ‘লাগেজ পার্টি’। সীমান্তে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব ওষুধ আনার ফলে দেশীয় কোম্পানি বাজার হারাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীমান্তে কেউ কেউ চোরাইপথে এসব ওষুধ আনছে। কেউবা ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে স্থলপথে আনছে। বিজিবি-বিএসএফ এর তল্লাশি থেকে রক্ষা পেতে চক্রের একাধিক ব্যক্তি একাধিক ব্যাগ বহন করে। কয়েকটি ব্যাগের জামা-কাপড়ের ভেতরে লুকিয়ে অল্প অল্প করে এসব ওষুধ আনা হয়। তল্লাশিতে ধরা পড়লে নিজের জন্য আনা হয়েছে মর্মে জানানো হয়। ক্ষেত্রবিশেষ তল্লাশিতে থাকা সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেও আনা হয়।
একাধিক সূত্র জানায়, লাগেজ পার্টি ইঞ্জেকশন ও বিভিন্ন ভ্যাকসিনও আনে। কিন্তু এসব ভ্যাকসিন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়। তা না হলে এর গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু লাগেজে করে চোরাই পথে এসব ভ্যাকসিন আনার সময় তাপমাত্রা মানা হয় না। যেমন এলার্জি, হাঁপানি ও ঠা-ার জন্য ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই ভ্যাকসিন নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় না রাখলে ভালোর চেয়ে শারীরিক ক্ষতিই বেশি হয়। চোরাই পথে আনা কয়েক ধরনের ভ্যাকসিন হাতিরপুল এলাকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
নকল ওষুধ তৈরি চক্রের বিরুদ্ধে এক কোম্পানিরই ৮০টি জিডি ॥ বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন এলাকার মার্কেট পরিদর্শনে গিয়ে নিজ কোম্পানির ওষুধ নকল হওয়ার বিষয়টি জানতে পারে জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যাল কর্তৃপক্ষ। পরে ওষুধ নকলকারী চক্রের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ৮০টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ বেলাল উদ্দিন আহমেদ।
ডাঃ বেলাল উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বাজারে স্যাম্পল দেখতে গিয়ে আমাদের বিভিন্ন ওষুধ নকল হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। এটি দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। পরে দেখি, দেশের বিভিন্ন এলাকায় আমাদের ওষুধ নকল করে বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু নকল ওইসব ওষুধ সাধারণ মানুষের পক্ষে চেনা সম্ভব নয়। পরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে বিভিন্ন সময়ে ৮০টি জিডি করেছি। জিডি জিডির মতোই পড়ে থাকত। তবে ইদানীং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে।
চক্রের মতো পাল্লা দিয়ে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ওষুধ উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠানও। সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদফতর থেকে অনুমোদন নিয়ে শর্ত না মেনে নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে বাজারজাতও করা হচ্ছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করায় ১৯টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইন্সেস বাতিল করা হয়েছে। সাময়িক বাতিল করা হয়েছে ৪৭টি প্রতিষ্ঠানের। উল্লেখিত সময়ে ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টে মামলা হয়েছে এক হাজার ৯৭৪টি। জরিমানা করা হয়েছে ৭ কোটি ৮৬ লাখ ৯২ হাজার ১০০ টাকা। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে ১০৬টি, আর ড্রাগ কোর্টে ১৯টি। এ সময়ে ওষুধের পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের জন্য মোট ৪ হাজার ৬৫৯টি ওষুধের নমুনা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩৫০টি ওষুধের নমুনা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে ওই সকল প্রতিষ্ঠানের ওষুধ ক্রয় না করতে এবং ব্যবস্থাপত্রে না লিখতে চিকিৎসকদের জানানো হয়েছে। জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক আইয়ুব হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, কে কি ধরনের লাইন্সেস নিয়ে কি ধরনের ওষুধ তৈরি করছে সেটি আমাদের কর্মকর্তারা তদারকি করেন। ফিল্ড অফিসাররা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। তবুও এ সমস্যা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায় সে বিষয়ে একটি পরিকল্পনা করে অভিযান পরিচালনা করা হবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করা হবে।
নকল ওষুধের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ এস এম মাহমুদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, নকল ওষুধ ব্যবহারে হার্ট, লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে মৃত্যুও হতে পারে। তাছাড়া গর্ভবতী নারী ও তার সন্তানের মারাত্মক ক্ষতিসহ মানবদেহে নানা ধরনের ক্ষতি হতে পারে। নকল এ্যান্টিবায়োটিক খেলে পরে দেখা যায়, আসল এ্যান্টিবায়োটিক খেলেও এর কার্যকারিতা থাকে না। ফলে ওই রোগীর চিকিৎসা করতে অনেক বেগ পেতে হয়।
নকল আর আসল ওষুধ চেনার উপায় ॥ আসল আর নকল ওষুধ চেনার উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ বেলাল উদ্দিন আহমেদ ও একমি কোম্পানির কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান বলেন, চক্রটি এমনভাবে ওষুধ তৈরি করে যা সাধারণ ক্রেতাদের চেনার কোন উপায় নেই। তবে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আসল আর নকল ওষুধের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারবে। ওষুধের প্যাকেটের সিকিউরিটি হলোগ্রামও নকল করছে। তবে ওষুধের প্যাকেটের গায়ে যে সিল থাকে সেটি ভাল করে দেখলে কোথাও কোন গলদ কিংবা লেবেল একই আছে কিনা, তা দেখে আসল আর নকল ওষুধের পার্থক্য বুঝা সম্ভব। আগের ওষুধের সঙ্গে পরের বার কেনার সময় প্যাকেটের সঙ্গে প্যাকেজিং, অক্ষরের ফন্ট, বানান, রং এগুলো মিলিয়েও বুঝা সম্ভব। ওষুধ খাওয়ার আগে ওষুধের রং, আকার, গঠন ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে। ওষুধের কোথাও কোন ভাঙ্গা অংশ থাকলে; গুঁড়া ওষুধের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিমাণে গুঁড়া থাকলে; ওষুধ ক্রিস্টালের মতো হলে বা যথেষ্ট শক্ত কিংবা অতিরিক্ত নরম হলে; ওষুধের ভেতরে কোথাও ফোলা বা দাগ থাকলে তা নকল ওষুধের লক্ষণ। কখনও নির্দিষ্ট দামের চেয়ে কম দামে ওষুধ না কেনার পরামর্শও দিয়েছেন তারা।

আরো খবর.......

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

নকল ওষুধে সয়লাব ॥ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি

আপডেট টাইম : ০৬:৪৬:০২ অপরাহ্ণ, শনিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

নকল ওষুধে সয়লাব ॥ জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি
একাধিক চক্র জড়িত
নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিও
১৯ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল
সময়ের কন্ঠ রিপোর্ট ॥
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দেশী-বিদেশী বহু কোম্পানির ওষুধ নকল করছে একাধিক চক্র। ক্যান্সার, হাঁপানি, হার্টের মতো নানা জটিল রোগের ওষুধ নকল করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাজারজাত করে আসছে তারা। এর সঙ্গে কিছু অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ী, কেমিক্যাল ব্যবসায়ী, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্টাফ, কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মীসহ বিভিন্ন পেশার লোক জড়িত রয়েছে। শুধু তাই নয়; ওষুধ উৎপাদনকারী দেশী প্রতিষ্ঠানও ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন করছে। আর তা দেদারছে বিক্রি হচ্ছে ফার্মেসিগুলোতে। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদনের দায়ে ১৯টি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইন্সেস বাতিল ও ৪৭টির সাময়িক বাতিল করেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর

দেশী-বিদেশী ওষুধ হুবহু নকল করে বাজারজাতকারী চক্রের একাধিক সদস্যকে সম্প্রতি আইনের আওতায় এনেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জব্দ করা হয়েছে কোটি কোটি টাকার নকল ও নিম্নমানের ওষুধ, কারখানা ও সরঞ্জামাদি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নকল ওষুধ বিপণন নেটওয়ার্কে রয়েছে ওষুধ ব্যবসায়ীরা। নেটওয়ার্কের কেন্দ্র মিটফোর্ড পাইকারি বাজার।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‌্যাব সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে যেসব নকল ওষুধ জব্দ করেছে সেগুলোর উপাদানে মূলত প্রয়োজনীয় জিনিসই নেই। তাছাড়া মেইজ স্টার্চ অত্যন্ত নি¤œ গ্রেডের ব্যবহৃত হয়। এমনকি স্টেরয়েড ও ডাই ব্যবহৃত হতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, নন ফার্মাসিউটিক্যালস গ্রেডের এসব কেমিক্যাল সেবনের ফলে মানুষের কিডনি, লিভার, হৃদযন্ত্র এবং শ্বাসতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। এমনকি জীবনণাশের হুমকিও রয়েছে।
বহুল আলোচিত কোম্পানির ওষুধ নকল ও বাজারজাত করার অপরাধে গত মাসের ১২ ও ১৩ তারিখে সাভার ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ থেকে আটজন এবং চলতি মাসের ২ তারিখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে সাতজনকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা বিভাগ। ২ তারিখে গ্রেফতার তরিকুল ইসলাম, সৈয়দ আল মামুন, সাইদুল ইসলাম, মনোয়ার, আবদুল লতিফ, নাজমুল ঢালী ও সাগর আহমেদ মিলনসহ প্রত্যেককে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে টিটিপাড়া, ডেমরাসহ বিভিন্ন এলাকায় ভেজাল ওষুধ তৈরির কারখানা ও বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাদি উদ্ধার করা হয়। চক্র দুটি ইউনানি লাইন্সেস নিয়ে ফার্মাসিউটিক্যালসের মন্টিলুকাস্ট, ওমিপ্রাজল ও সেফিক্সিম গ্রুপের ওষুধ নকল করে দীর্ঘদিন ধরে বাজারজাত করে আসছিল। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ভেজাল ওষুধ, ওষুধ তৈরির মেশিন ও ডাইস জব্দ করা হয়।

সাভার ও নেছারাবাদ কারখানায় ভেজাল ওষুধ তৈরির কেমিস্ট হিসেবে কাজ করত আতিয়ার নামে একজন। আতিয়ার মূলত একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কাজ করত। পরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে চক্রের কেমিস্ট হয়ে কাজ করে আসছিল। চক্রের অন্যরা প্যাকেজিং, কেমিক্যাল জোগানের কাজ করত। পরে ভেজাল ওষুধ তৈরি করে মিটফোর্ড এলাকার কতিপয় অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে মিটফোর্ড ডিপোতে এনে রাখত। গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেফতারকৃত ১৫ জনের মধ্যে বেশি সংখ্যক মিটফোর্ড এলাকার। মিটফোর্ড কেন্দ্রিকই চক্রের চারটি গ্রুপ রয়েছে। সেখানকার ওষুধ ব্যবসায়ীর পাশাপাশি কিছু সংখ্যক লেবারও জড়িত। মিটফোর্ড থেকে চক্রটি অর্ডার অনুযায়ী এস.এ পরিবহন, সুন্দরবন ও ইউএসবি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় (বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং ঢাকা, বরিশাল ও রংপুরে বেশি) সরবরাহ করত। এসব কুরিয়ার সার্ভিসের বেশ কয়েকজন স্টাফ নকল ওষুধ বাজারজাতকরণে সহায়তা করে আসছিল।
ডিবির লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মোঃ সাইফুর রহমান আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, চক্র দুটির বিভিন্ন সেক্টরে লোক রয়েছে। পরস্পরের যোগসাজশে দীর্ঘদিন ধরে তারা ওষুধ নকল করে আসছিল। এক চক্রেরই ২২ জনের নাম পাওয়া গেছে। পুরো চক্রটিকে আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে।
নকল হচ্ছে বিদেশী ওষুধ ॥ শুধু দেশীয় ওষুধ নয়; বিদেশী ওষুধও দেশে নকল করছে একাধিক চক্র। আগে বিদেশী ওষুধের প্যাকেট তৈরি করে পরে বিদেশী ওষুধের স্যাম্পল সংগ্রহ করে হুবহু নকল করা হচ্ছে। বিদেশী ওষুধ নকল ও বাজারজাত করার সঙ্গে জড়িত কয়েকটি চক্রকে আটকের পর এমনটি জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

২৯ জুন হাতিরপুল, রামপুরা ও মালিবাগ থেকে আমেরিকা-চায়না ব্রান্ডের নামে নকল ওষুধসহ লুবনা আক্তার, আনোয়ার কাজী, রামচন্দ্র বসাক, এসএম তাজমুল তারিক ও কনক কুমার সাহা নামের পাঁচজনকে গ্রেফতার করে ডিবি গুলশান বিভাগ। এরা অনুমোদন ছাড়া নারায়ণগঞ্জ জালকুড়িতে অবস্থিত কারখানায় বিদেশী ওষুধ নকল করত। অনুমোদনবিহীন বিভিন্ন ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল কেজি দরে অথবা হাজার পিস ধরে কিনে নিয়ে যে যার ইচ্ছামত জেনেরিক নেম অথবা ট্রেড নেম দিয়ে কখনও হার্টের ওষুধ, কখনও লিভারের ওষুধ, কখনও হাড়ের ওষুধ এবং বেশিরভাগ সময় সেক্সের ওষুধ হিসেবে আমেরিকা অথবা চায়না থেকে ইমপোর্ট করা হয়েছে বলে চালিয়ে দিত। চক্রটি চকবাজার, মিটফোর্ড এলাকা থেকে বস্তা ভরা প্লাস্টিকের সাদা লাল সবুজ রঙের বোতল, সিপি, সিলিকন সংগ্রহ করত। কম্পিউটারের দোকান থেকে ইংরেজীতে এ্যাম্বুস করে লেখা বিভিন্ন হলোগ্রাম, মনোগ্রামসম্বলিত ঝকঝকে রঙিন স্টিকার ও লেবেল তৈরি করে লেবেলে এ্যালেক্স ইন্টারন্যাশনাল, রেমেডি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, অর্গানন হেলথ কেয়ার, সান করপোরেশনের মতো বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানির নামে ইমপোর্ট এবং মার্কেটিং করা হয় মর্মে লেখা থাকত। যার কোন অস্তিত্ব¡ই নেই।
সম্প্রতি বংশাল থেকে পাঁচ লাখ টাকা মূল্যের ছয় হাজার ৪৬৪ পিস বিক্রয় নিষিদ্ধ ভারতের ওষুধসহ বাপ্পী চন্দ্র নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১০। গ্রেফতার বাপ্পীসহ চক্রের আরও তিনজনে (পলাতক) মিলে ক্যান্সার, হার্টের বিদেশী ওষুধ নকল করত। এরা লাগেজে করে সীমান্তে পথে ভারতীয় ওষুধ দেশে এনেছে। তবে আগ থেকেই চক্রটি ভারতের ওইসব ওষুধের প্যাকেট বানিয়ে রাখত বলে জানিয়েছেন র‌্যাব-১০ এর কোম্পানি কমান্ডার (সিপিসি-৩) মেজর আনিসুজ্জামান।
নকল ওষুধ বিপণন নেটওয়ার্কে মিটফোর্ড কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময় নকল ওষুধ তৈরি, বাজারজাত করার সঙ্গে যাদের গ্রেফতার করেছে তাদের বেশির ভাগই মিটফোর্ড কেন্দ্রিক চক্র। মূলত মিটফোর্ড কেন্দ্রিক কতিপয় অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীর সমন্বয়ে নকল ওষুধ উৎপাদন, কেমিক্যাল সরবরাহ ও বাজারজাত করে আসছিল তারা। মিটফোর্ড থেকে সারাদেশের ওষুধ ব্যবসায়ীরা পাইকারি দরে ওষুধ ক্রয় করে থাকেন। এই সুযোগে মিটফোর্ডের পাইকারি বাজারকে বেছে নিয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ রয়েছে, ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠনের ছত্রছায়ায় এমন অপকর্ম করে আসছে কিছু ব্যবসায়ী। সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের কেউ কেউ জড়িত রয়েছে বলেও বিভিন্ন সময়ে নাম এসেছে। ওই এলাকায় মোবাইল কোর্টে পরিচালনা করতে গিয়ে অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীদের বাধার সম্মুখীন হওয়ার ঘটনাও অতীতে ঘটেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিস্ট এ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সহসভাপতি কাজী কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের সংগঠন ওষুধ নকলের ঘোরবিরোধী। আমরাও চাই, নকল ওষুধ উঠে যাক। তবে যারা এসব করছে তারা আমাদের ব্যবসায়ী ঠিক আছে। তারা সামনে একটা বলে, পেছনে আরেকটা করে। অভিযান চালালে কয়দিন বন্ধ থাকে, আবার যেই সেই অবস্থা।
সীমান্তে সক্রিয় ‘লাগেজ পার্টি’ ॥ বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তের একাধিক পথ দিয়ে আনা হচ্ছে বিদেশী ওষুধ। বিশেষ করে ভারতীয় ওষুধ। ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে আনা এসব ওষুধ বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। যারা সীমান্ত পথে ওষুধ আনছে তাদের বলা হয় ‘লাগেজ পার্টি’। সীমান্তে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব ওষুধ আনার ফলে দেশীয় কোম্পানি বাজার হারাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সীমান্তে কেউ কেউ চোরাইপথে এসব ওষুধ আনছে। কেউবা ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে স্থলপথে আনছে। বিজিবি-বিএসএফ এর তল্লাশি থেকে রক্ষা পেতে চক্রের একাধিক ব্যক্তি একাধিক ব্যাগ বহন করে। কয়েকটি ব্যাগের জামা-কাপড়ের ভেতরে লুকিয়ে অল্প অল্প করে এসব ওষুধ আনা হয়। তল্লাশিতে ধরা পড়লে নিজের জন্য আনা হয়েছে মর্মে জানানো হয়। ক্ষেত্রবিশেষ তল্লাশিতে থাকা সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেও আনা হয়।
একাধিক সূত্র জানায়, লাগেজ পার্টি ইঞ্জেকশন ও বিভিন্ন ভ্যাকসিনও আনে। কিন্তু এসব ভ্যাকসিন একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়। তা না হলে এর গুণগত মান নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু লাগেজে করে চোরাই পথে এসব ভ্যাকসিন আনার সময় তাপমাত্রা মানা হয় না। যেমন এলার্জি, হাঁপানি ও ঠা-ার জন্য ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই ভ্যাকসিন নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় না রাখলে ভালোর চেয়ে শারীরিক ক্ষতিই বেশি হয়। চোরাই পথে আনা কয়েক ধরনের ভ্যাকসিন হাতিরপুল এলাকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বিক্রি করা হচ্ছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
নকল ওষুধ তৈরি চক্রের বিরুদ্ধে এক কোম্পানিরই ৮০টি জিডি ॥ বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন এলাকার মার্কেট পরিদর্শনে গিয়ে নিজ কোম্পানির ওষুধ নকল হওয়ার বিষয়টি জানতে পারে জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যাল কর্তৃপক্ষ। পরে ওষুধ নকলকারী চক্রের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ৮০টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ বেলাল উদ্দিন আহমেদ।
ডাঃ বেলাল উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, বাজারে স্যাম্পল দেখতে গিয়ে আমাদের বিভিন্ন ওষুধ নকল হওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। এটি দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। পরে দেখি, দেশের বিভিন্ন এলাকায় আমাদের ওষুধ নকল করে বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু নকল ওইসব ওষুধ সাধারণ মানুষের পক্ষে চেনা সম্ভব নয়। পরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে বিভিন্ন সময়ে ৮০টি জিডি করেছি। জিডি জিডির মতোই পড়ে থাকত। তবে ইদানীং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে।
চক্রের মতো পাল্লা দিয়ে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠিত ওষুধ উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠানও। সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদফতর থেকে অনুমোদন নিয়ে শর্ত না মেনে নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করে বাজারজাতও করা হচ্ছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করায় ১৯টি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইন্সেস বাতিল করা হয়েছে। সাময়িক বাতিল করা হয়েছে ৪৭টি প্রতিষ্ঠানের। উল্লেখিত সময়ে ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টে মামলা হয়েছে এক হাজার ৯৭৪টি। জরিমানা করা হয়েছে ৭ কোটি ৮৬ লাখ ৯২ হাজার ১০০ টাকা। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে মামলা দায়ের হয়েছে ১০৬টি, আর ড্রাগ কোর্টে ১৯টি। এ সময়ে ওষুধের পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের জন্য মোট ৪ হাজার ৬৫৯টি ওষুধের নমুনা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩৫০টি ওষুধের নমুনা পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে ওই সকল প্রতিষ্ঠানের ওষুধ ক্রয় না করতে এবং ব্যবস্থাপত্রে না লিখতে চিকিৎসকদের জানানো হয়েছে। জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক আইয়ুব হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, কে কি ধরনের লাইন্সেস নিয়ে কি ধরনের ওষুধ তৈরি করছে সেটি আমাদের কর্মকর্তারা তদারকি করেন। ফিল্ড অফিসাররা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছেন। তবুও এ সমস্যা থেকে কিভাবে বেরিয়ে আসা যায় সে বিষয়ে একটি পরিকল্পনা করে অভিযান পরিচালনা করা হবে। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করা হবে।
নকল ওষুধের ভয়াবহতা প্রসঙ্গে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ এস এম মাহমুদুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, নকল ওষুধ ব্যবহারে হার্ট, লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে মৃত্যুও হতে পারে। তাছাড়া গর্ভবতী নারী ও তার সন্তানের মারাত্মক ক্ষতিসহ মানবদেহে নানা ধরনের ক্ষতি হতে পারে। নকল এ্যান্টিবায়োটিক খেলে পরে দেখা যায়, আসল এ্যান্টিবায়োটিক খেলেও এর কার্যকারিতা থাকে না। ফলে ওই রোগীর চিকিৎসা করতে অনেক বেগ পেতে হয়।
নকল আর আসল ওষুধ চেনার উপায় ॥ আসল আর নকল ওষুধ চেনার উপায় সম্পর্কে জানতে চাইলে জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ বেলাল উদ্দিন আহমেদ ও একমি কোম্পানির কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান বলেন, চক্রটি এমনভাবে ওষুধ তৈরি করে যা সাধারণ ক্রেতাদের চেনার কোন উপায় নেই। তবে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আসল আর নকল ওষুধের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারবে। ওষুধের প্যাকেটের সিকিউরিটি হলোগ্রামও নকল করছে। তবে ওষুধের প্যাকেটের গায়ে যে সিল থাকে সেটি ভাল করে দেখলে কোথাও কোন গলদ কিংবা লেবেল একই আছে কিনা, তা দেখে আসল আর নকল ওষুধের পার্থক্য বুঝা সম্ভব। আগের ওষুধের সঙ্গে পরের বার কেনার সময় প্যাকেটের সঙ্গে প্যাকেজিং, অক্ষরের ফন্ট, বানান, রং এগুলো মিলিয়েও বুঝা সম্ভব। ওষুধ খাওয়ার আগে ওষুধের রং, আকার, গঠন ঠিক আছে কিনা দেখতে হবে। ওষুধের কোথাও কোন ভাঙ্গা অংশ থাকলে; গুঁড়া ওষুধের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিমাণে গুঁড়া থাকলে; ওষুধ ক্রিস্টালের মতো হলে বা যথেষ্ট শক্ত কিংবা অতিরিক্ত নরম হলে; ওষুধের ভেতরে কোথাও ফোলা বা দাগ থাকলে তা নকল ওষুধের লক্ষণ। কখনও নির্দিষ্ট দামের চেয়ে কম দামে ওষুধ না কেনার পরামর্শও দিয়েছেন তারা।